কলম্বো ফ্যাশন উইকে বাংলা সুর

আফসানা ফেরদৌসি
ছবি: সংগৃহীত

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ফেসবুকে কভার ফটোতে আমার সংগ্রহের একটা ছবি দিয়েছিলাম। ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ আয়োজিত খাদি ফ্যাশন শোতে আমার সংগ্রহের ছবি। তার এক-দুদিন পরই একজন ইনবক্স করে আমার কাছে কিছু ছবি চাইলেন। পরে বুঝতে পারি, তিনি কলম্বো ফ্যাশন উইকের একজন আয়োজক। কয়েক দিনের মধ্যেই যোগদানের আমন্ত্রণ। নিবন্ধন ফি আর সব খরচা নিজের হবে বলে অনেকগুলো ভালো ফ্যাশন শোতে আমি অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এখানে সব খরচ তাঁরাই দেবেন। আর এভাবেই শুরু হলো আমার কলম্বো ফ্যাশন উইক-যাত্রা।

কলম্বো ফ্যাশন উইকে প্রশংসিত আফসানার সংগ্রহ

কলম্বো ফ্যাশন উইক সম্পর্কে আগে থেকেই জানতাম। এটি এশিয়ার অন্যতম সেরা একটি ফ্যাশন আয়োজন। এখানে অনেক নামকরা ডিজাইনারের কাজ দেখেছি। বিবি রাসেল আপাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাই একজন তরুণ বাংলাদেশি হিসেবে নিজের দেশকে ফ্যাশনজগতে তুলে ধরতে পারব বলে অনেক আনন্দিত ছিলাম।

আমার কাছে তখন ১৮টি লুকের পোশাক ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দিনরাত কাজ করে আরও ৫টি লুক তৈরি করি। আরও করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে পারিনি।

কলম্বো ফ্যাশন উইকে প্রতিদিন নিজের নকশা করা পোশাক, গয়না, জুতা পরেছেন আফসানা

৫ মার্চ বিকেলে কলম্বো পৌঁছাই। ওই দিন সন্ধ্যায় ডিজাইনারদের একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে শ্রীলঙ্কা, ভারত, ইতালি থেকে আসা ডিজাইনারদের সঙ্গে দেখা হয়। সঙ্গে ছিল আলোকচিত্রী, কোরিওগ্রাফার, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতসহ ফ্যাশন দুনিয়ার আরও অনেকে।

৬ মার্চ সকালে ছিল মডেলদের সঙ্গে ড্রেস ফিটিং। বাংলাদেশি মডেলদের জন্য বানানো সব পোশাক ওখানে ফিট হয়েছিল। তারপর সন্ধ্যায় কলম্বো ফ্যাশন উইকের প্রথম দিন ছিল উদীয়মান ডিজাইনারদের সংগ্রহ। এরপর তিন দিন ছিল শ্রীলঙ্কা ও আন্তর্জাতিক ডিজাইনারদের ফ্যাশন শো। আমার শো ছিল ৭ মার্চ।

ডেইলি মিররে আফসানা

সকাল থেকে মঞ্চের পেছনে পোশাক গোছানো, কোরিওগ্রাফি, সংগীত যাচাই, কাপড় ইস্তিরি—এসব চলেছে। তারপর বিকেলে গল ফেস হোটেলে গিয়ে প্রস্তুত হয়ে এলাম।

তাজ সমুদ্র হোটেলে হয়েছিল আমাদের ফ্যাশন শো। ওই দিন শোতে ছিলেন ভারতীয় ডিজাইনার আব্রাহাম অ্যান্ড ঠাকুর, মানুবিরাজ কুশলা, শ্রীলঙ্কান আমিলানি, লিমাক বাই কামিল এবং বাংলাদেশ থেকে আফসানা ফেরদৌসী। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে শুরু হয় আমাদের শো।

পোশাকের সঙ্গে ছিল হাতে বানানো গয়না আর মুখোশ

আমার সংগ্রহের নাম ছিল ইমোশনাল ওয়েভ ইন খাদি টেক্সটাইল। যেখানে আমার ২৩টি পোশাকের রানওয়ে লুক ছিল। হাতে বোনা খাদির মধ্যে অফ হোয়াইট রঙে থ্রিডি ভাব আনা হয়েছিল। যেখানে আমাদের মানুষের অনুভূতিকে জ্যামিতিক, ফুলেল মোটিফে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। আর এই সংগ্রহে ছিল আমাদের অনেক রকমের হাতে বোনা খাদি। বিভিন্ন টেক্সচার এবং ওজনের এই কাপড়ের জন্য আমাদের ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশকে বিশেষ ধন্যবাদ। তাদের প্রচেষ্টাতেই এত সুন্দর কাপড় নিয়ে আমরা ডিজাইনাররা কাজ করতে পারছি। আমার পোশাকের সংগ্রহে কাদা দিয়ে হাতে বানানো কানের দুল এবং নেকলেস ছিল। ওখানে বাংলাদেশের ফুল কৃষ্ণচূড়া, গন্ধরাজ, শাপলা যেমন ছিল, তেমনি ছিল আমাদের বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, প্যাঁচা, মাছ। পাটের তৈরি জুতাও ছিল, কিন্তু অতিরিক্ত ওজনের কারণে বাংলদেশের বিমানবন্দরে রেখে আসতে হয়েছিল। এই সংগ্রহের একটি চমক ছিল খবরের কাগজ দিয়ে বানানো টেপা পুতুলের আদলে তৈরি মুখোশ, যা দেখতে টেপা পুতুলের মতো, মনে হয় মাটির তৈরি।

মুখোশের মাধ্যমে আমি বলতে চেয়েছি, আমরা সবাই এক। এখানে গায়ের রং, চেহারা, নারী-পুরুষ—এসব কোনো ভেদাভেদ নেই। তাই আমার মডেলরা যখন পাশাপাশি দাঁড়াই, কেউ বলতে পারবে না যে এই মানুষটি সুন্দর, আর ওই মানুষটি অসুন্দর। এখানে সবাই সমান। আর আমরা এমন একটি পৃথিবী চাই, যেখানে মানুষ মানুষকে সম্মান করবে।

শো শেষে মডেলদের সঙ্গে আফসানা

এবার আসি আমার শোয়ের বিষয়ে। রানওয়েতে আমি বাংলা সুর ব্যবহার করি। সত্যি বলতে, মানুষ খুবই উপভোগ করেছে ওই সুর। কৃষ্ণচূড়া থ্রিডি পোশাক দিয়ে শুরু করি। তারপর একে একে আসে ২৩ জন মডেল। যাঁদের কারও পোশাকে ছিল জ্যামিতিক নকশা। থ্রিডি করে মূল কাপড় দিয়েই হাতে বানানো। একটা ড্রেস ছিল দূর থেকে দেখে মনে হবে গর্ত হয়ে আছে, যা কাপড়েরই থ্রিডি ধরন। তেমনি ছিল মাশরুমের আদলে তৈরি সারফেস অলংকরণ, যা দেখে অনেকের সাগরপাড়, প্রবালের কথা মনে হবে। ছিল স্মোকিংয়ের কাজ, ছিল গাছের শিকড়ের মতো কাপড়ের থ্রিডি ডিজাইন, ছিল কাপড়ের ফুল, মৌমাছি। ২৩ জন মডেলের সবাই মুখে টেপা পুতুল মুখোশ পরে খালি পায়ে মঞ্চে হাঁটেন।

মানুষ যে আমার কাজ এতটা পছন্দ করবে, আমি নিজেও তা প্রত্যাশা করিনি। শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারেক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম ওখানে ছিলেন। তিনি আমাকে বলছিলেন, মানুষ আপনার চিন্তা, কাজ আর টেপা পুতুল দেখে মুগ্ধ। ফেসবুকে ঢুকে দেখি, অনেকে আমার কাজের ছবি পোস্ট করে ট্যাগ করছে, অনেকে আমার সংগ্রহ কিনতে চাচ্ছে। পরদিন শ্রীলঙ্কান ডেইলি মিরর-এ দেখি, ফ্যাশন উইকের রিভিউয়ে লেখা হয়েছে, আমার সংগ্রহ এই পত্রিকার ফ্যাশন সমালোচকের সবচেয়ে পছন্দের। পরের কয়েক দিন অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন, কীভাবে আমার সংগ্রহ তাঁরা কিনতে পারবেন। দেশের বাইরে আমার সংগ্রহের চাহিদা দেখে খুবই ভালো লাগল।

কাপড়ে হাতে বানানো মাশরুমের থ্রি ডি ইফেক্ট

কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন ভারতের নয়নিকা চ্যাটার্জি ও তাঁর দল। সঙ্গে ছিলেন একঝাঁক শ্রীলঙ্কান মডেল। এই ফ্যাশন শোতে আমি যেমন দেশকে তুলে ধরে আনন্দিত হয়েছি, তেমনি অনেক কিছু শিখেছি। একজন বাংলাদেশি ডিজাইনার হিসেবে শুরু থেকেই চেষ্টা করেছি নিজের দেশের ফ্যাশনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে। কলম্বো ফ্যাশন উইক ছিল এই বছরের প্রথম যাত্রা।

কলম্বো সুন্দর শহর। ওখানকার মানুষেরাও উদার, আন্তরিক। ওখানে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশি ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাজ কোনো অংশে কম নয়। মার্কেটিংয়ের অভাবে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। বাংলাদেশের সব ফ্যাশন ডিজাইনাররা মিলে যদি একে অন্যের পথচলার রাস্তাটা আরও সুগম করে দেন, পাশে থাকেন, তাহলে সেই রাস্তা ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের কাজ তুলে ধরা, পৌঁছে দেওয়া আরও সহজ হয়ে যায়।