ভারত যেভাবে টাঙ্গাইলের শাড়ি নিজেদের বলে নিবন্ধন করল, আমাদের এখন যা করতে হবে

বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের শাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। অথচ টাঙ্গাইল কোথায়? টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের নিবন্ধিত হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় আর বাংলাদেশিদের চলছে অনলাইন-যুদ্ধ। যাঁরা এখন ভারতকে দোষারোপ করছেন, তাঁদের কেউ কেন এত দিন টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেননি বা করতে উৎসাহিত করেননি? শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) নিশ্চিত করেছে, আজ শনিবার পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের দপ্তর, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বা বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন) পক্ষ থেকে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআইয়ের আবেদন জমা পড়েনি!  

বাংলাদেশের ‘পলিসিগত’ দুর্বলতা

যে পণ্যগুলো ভারত-বাংলাদেশ, দুই দেশেই উৎপাদিত হয়, ভারত ‘স্বাভাবিক’ভাবেই সবার আগে সেগুলোর স্বত্ব নিজেদের নামে নিবন্ধন করতে চাইবে। খোদ ইউরোপের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আইনি লড়াই চলে বছরের পর বছর। বাংলাদেশের জনপ্রিয় পণ্যগুলোর জিআই স্বীকৃতি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ‘পলিসিগত’ দুর্বলতা ছাড়া আর কী?

বাংলাদেশের নারীদের আবহমান সাংস্কৃতিক পোশাক হিসেবে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির অবস্থান একেবারে প্রথম দিকেই।

এর আগে রসগোল্লা, নকশিকাঁথা, ফজলি আম ও নারকেলের মোয়ার স্বত্বও ভারতের হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। সুন্দরবনের মধুও ভারতের হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। অথচ এগুলো বাংলাদেশেরও হতে পারত। নিজেরা সচেতন না হয়ে, শিক্ষা না নিয়ে, আবেদন না করে কেবল একতরফাভাবে ভারতকে দোষারোপ করে লাভ কী?

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে জয়া

এই মুহূর্তে যা করতে হবে


ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজীব আহমেদ বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি তো অনেক ধরনের। বালুচরি, হাফ সিল্ক—১০ থেকে ১৫ ধরনের টাঙ্গাইলের শাড়ি আছে। এ ছাড়া সিলেটের মণিপুরি, যশোরের নকশি, ঢাকার মিরপুরের কাতান—এই শাড়িগুলোর জিআই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব। ইতিমধ্যে যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, তা তো বুঝতেই পারছেন।’

রাজীব আহমেদ আরও জানান যে শাড়ি ছাড়াও যে পণ্যগুলো ভারত আর বাংলাদেশ, দুই দেশেই উৎপাদিত হয়, সেগুলোর আগে জিআইয়ের স্বীকৃতি নিতে হবে। দীর্ঘ প্রক্রিয়া ঠেলেই আবেদন করতে হবে। আবেদন করার জন্য যা যা ‘রিকয়ারমেন্ট’ আছে, তা পূরণ করেই করতে হবে। যেমন সাতকরার আচার বাংলাদেশের সিলেটেও হয়, আবার ভারতের আসামেও। দিনাজপুরের লিচু—এগুলোর জন্যও আবেদন করতে হবে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজার, যেমন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের জিআইভুক্ত পণ্যগুলো তালিকাবদ্ধ করতে হবে। তারপর যে পণ্যগুলোর জিআই স্বত্ব ভারত নিয়েছে, সেটা যে অযৌক্তিক, তার উপযুক্ত নথি-প্রমাণসহ জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) বরাবর অভিযোগ করতে হবে।

ভারত কেন টাঙ্গাইলের শাড়ি নিজেদের বলে নিবন্ধন করল

যে পণ্যগুলো ভারতসহ অন্য দেশেও উৎপাদিত হয়, ভবিষ্যতে ঝামেলা এড়াতে, নিজেদের সবচেয়ে বেশি পণ্য জিআইয়ের তালিকাভুক্ত করতে ভারত সবার আগে সেই পণ্যগুলোই নিজেদের বলে স্বীকৃতি নিয়ে নিচ্ছে! নিজেদের পক্ষে যায়, এমন সমস্ত তথ্য উপাত্ত সামনে আনছে। জিআইয়ের ক্ষেত্রে যে কোন দেশের অভ্যন্তরীর পলিসি ‘এরকমই’ হওয়া উচিৎ (তাই বলে অন্যায় বা অযৌক্তিকভাবে নয়)।

দেশভাগের পর টাঙ্গাইলের অনেক হিন্দু তাঁতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। নদীয়া জেলার ফুলিয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের কলোনিতে তাঁরা থিতু হয়ে নতুন করে সাবেকি পেশাকেই আঁকড়ে ধরেন, তাঁতে শাড়ি বুনে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেন। সেই সূত্রেই দ্রুততার সঙ্গে (যেহেতু বাংলাদেশ এর প্রধান ভাগীদার) এই শাড়ির স্বীকৃতি নিয়ে নিয়েছে ভারত।

বাংলাদেশের নারীদের আবহমান সাংস্কৃতিক পোশাক হিসেবে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির অবস্থান একেবারে প্রথম দিকেই।

বাংলাদেশ এখনো পারবে

বাংলাদেশ এখনো টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করতে পারবে। এক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। ভারত টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানে উৎসারিত পণ্য হিসেবে জিআই নিবন্ধন করেছে। এর পেছনে যেসব দাবি ও তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে আর যা-ই হোক, টাঙ্গাইল যে পশ্চিমবঙ্গে, সেটা অন্তত প্রমাণের সুযোগ নেই। আর এখানেই এগিয়ে বাংলাদেশ। কারণ, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে টাঙ্গাইল বাংলাদেশে। কাজেই দ্রুত বাংলাদেশেরও টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে। তারপর সেটা আন্তর্জাতিক বাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে।

এরপর ভারতের জিআই নিবন্ধনকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে। যদিও কাজটা বেশ জটিল, ব্যয়সাপেক্ষ ও কঠিন।

কীভাবে মেলে জিআই

যেকোনো ঐতিহ্যবাহী পণ্য জিআই করার আগে দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এই স্বীকৃতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি)। আর যে জেলার পণ্য জিআই হবে, তার জেলা প্রশাসক বা সরকারি কোনো দপ্তরকে আবেদন করতে হয়। কিন্তু দেখা গেছে, পণ্যের তালিকা করেও দীর্ঘ সময় ধরে এসব জেলা বা সরকারি কর্তৃপক্ষ ওই পণ্যের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জমা দেয়নি। পণ্য জিআই হতে গেলে পণ্যের অন্তত ৫০ বছরের ঐতিহ্য থাকতে হয়, যে এলাকার পণ্য, তার স্বীকৃতি থাকতে হয়। ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজই শুধু নয়, প্রাচীন সাহিত্য-পুঁথি-ছড়ায় কোনো উল্লেখ থাকলেও প্রমাণ হিসেবে তা তুলে ধরা হয়। এসব খুঁজে বের করা গবেষণার বিষয়।

উ’ৎসবেও টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির জনপ্রিয়তা ব্যাপক

জিআইয়ের স্বীকৃতি মেলা কেন জরুরি

দিন যত যাচ্ছে, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে তত বাড়ছে পণ্যের স্বত্বের গুরুত্ব। এ কারণেই জিআই নিয়ে এত তোড়জোড়। কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর কোনো সংস্কৃতি যদি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেই পণ্য ওই অঞ্চলের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও জিআইয়ের স্বীকৃতি একটা বড় সুবিধা। সারা বিশ্বেই জিআইয়ের স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই বাসমতী চালের স্বত্ব নিয়ে পাকিস্তান, ভারত আর নেপালের আইনি যুদ্ধ চলছে তো চলছেই!

স্বীকৃতি মিলেছে ২১ বাংলাদেশি পণ্যের

২০১২ সালের দিকে জামদানি শাড়ি, আম ও ইলিশকে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেয় ভারত। অথচ এসব পণ্য বাংলাদেশেও আছে। কিন্তু পণ্য জিআই করার জন্য দেশে তখন কোনো আইন ছিল না। বেশ দ্রুততার সঙ্গে ২০১৩ সালে সেই আইন হলো। আর প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত হলো জামদানি। বাংলাদেশের পণ্য হিসেবেই নথিভুক্ত হলো এই শাড়ি। ভারতও জামদানিকে জিআই পণ্য হিসেবে নথিভুক্ত করল, তবে ‘উপাধা জামদানি’ নামে। বাংলাদেশে এরপর একে একে স্বীকৃতি পায় ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। আর সম্প্রতি জিআই স্বীকৃতি পেল টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এবং ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল।