আরব সাগরের একেবারে গা ঘেঁষে ‘দ্য ওবেরয় মুম্বাই’ হোটেল। পর্যটকদের ফেলে দেওয়া খাবার মুখে নিয়েই উড়ে যাচ্ছে কাক। প্রেমিক–প্রেমিকারা হাত ধরে সাগরের কোল ঘেঁষে হাঁটছে। এই পাঁচ তারকা হোটেলের বারান্দায় বসে সমুদ্রের হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে চলছে এক তরুণীর ফলাহার। উপভোগ করছেন ‘সি ভিউ’। ফলের বাটির পাশেই ভাঁজ করে রাখা টিস্যু। সেখানে লাল অক্ষরে লেখা ‘সোবিয়া’।
ভারতীয় মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে শক্তপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ মডেল সোবিয়া আমিন। বিশ্বখ্যাত ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের ইতালীয় আর ভারতীয় সংস্করণে আগেই তাঁকে নিয়ে ফিচার হয়েছে। একাধিক বলিউড তারকাকে হটিয়ে দেখা দিয়েছেন ‘হারপারস ম্যাগাজিন’–এর (ভারতীয় সংস্করণ) প্রচ্ছদে। এবার ‘ভোগ ভারত’–এর পক্ষ থেকে তিনি পেলেন সম্মানজনক একটি অ্যাওয়ার্ড। ভোগ সোবিয়াকে যে মেইল করেছে, তাতে লেখা হয়েছে, সোবিয়াকে এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার মাধ্যমে তারা নিজেরাই সম্মানিত। ভারতের পাঁচ তারকা হোটেল দ্য ওবেরয় মুম্বাইয়ে ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় এক আলো–ঝলমলে আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেওয়া হলো এই পুরস্কার। হোয়াটসঅ্যাপে ঢাকা থেকে মুম্বাইয়ের দূরত্ব ঘুচিয়ে চলল কথোপকথন। সোবিয়া আমিন–এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জিনাত শারমিন
অভিনন্দন, অভিনন্দন। এই অ্যাওয়ার্ডের নাম কী?
‘ফোর্সেস অব ফ্যাশন’। ‘আউটস্ট্যান্ডিং কন্ট্রিবিউশন ইন ইন্ডিয়ান ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি (ভারতীয় ফ্যাশনশিল্পে অসামান্য অবদান)’ ক্যাটাগরির অধীনে ওরা বেশ কয়েকজনকে এই পুরস্কার দিল। আমাকে মঞ্চে ডাকার আগে বলা হয়েছে, ‘এ বছর যেসব আন্তর্জাতিক মডেল ভারতের মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিকে আরও অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বমূলক করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা না করে সাহস আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, অন্যদের এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করেছেন, বাংলাদেশি তরুণ স্থপতি ও মডেল সোবিয়া আমিন তাঁদেরই একজন। ভারতীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে আপনার ভূমিকার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আপনাকে এই পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে আমরা নিজেরাই সম্মানিত।’ ওরা আগামী জানুয়ারিতে এই অ্যাওয়ার্ডের বিষয়টা ম্যাগাজিনে প্রকাশ করবে। ভোগ ইন্ডিয়ার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ইতিমধ্যে আমাদের ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
এরপর ওখানে আর কী কাজ?
এ সপ্তাহে আমার ‘মুকেশ আম্বানি কালচালার সেন্টার’–এর জন্য একটা শুট আছে। সাক্ষাৎকারও দিতে হবে। সেটা শেষ করে সপ্তাখানেক পর ঢাকায় ফিরব।
আপনি কীভাবে এত অল্প সময়ে ভারতের মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের এত শক্ত অবস্থান গড়লেন?
কী জানি! তবে যেটা ঘটেছে, সেটার জন্য আমি সারা জীবন মাসাবা গুপ্তার কাছে কৃতজ্ঞ। মাসাবার কাজ দিয়ে আমার যাত্রা শুরু। উনি আমাকে চুক্তিতে বেঁধে ফেলতে পারতেন। আমি তখন কয়েক বছর মাসাবা আর মাসাবার ফ্যাশন ও বিউটি ব্র্যান্ড ছাড়া আর কারও সঙ্গে কাজ করতে পারতাম না। আমি তো তখন প্রায় কিছুই বুঝতাম না। চাইলে উনি সেটা করতেই পারতেন। উনিই আমাকে আবিষ্কার করেছেন। ইনস্টাগ্রামে ‘মাসাবা’র পোশাকে আমার ছবি দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমাকে মাসাবার পোশাক পাঠানো হলে আমি ছবি তুলে পাঠাতে পারব কি না! ওনার সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে উনি আমার ভেতরে কী দেখেছিলেন। উনি বলেছিলেন, ‘কিছু একটা, যেটা তোমার চোখে প্রতিফলিত হয়, যেটা মডেলিংয়ের ভেতর দিয়েই সবচেয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশ করা যায়। তুমি আর মডেলিং, দুজনের দুজনকে প্রয়োজন।’ মাসাবার সঙ্গে শুটটা ভাইরাল হলো। একে একে ভারতের প্রথম সারির এমন কোনো ফ্যাশন ব্র্যান্ড নেই, যার সঙ্গে আমি কাজ করিনি। আমি এ জন্য আজীবন মাসাবার কাছে কৃতজ্ঞ। উনি আমাকে আবিষ্কার করেছেন আর নিজের সম্ভাবনা যাচাই করে নিজেকে মেলে ধরতে দিয়েছেন।
বাংলাদেশে কোনো কাজ করেন না?
আমার কিছু বলার নেই... (কয়েক সেকেন্ড নীরবতা) সরি বাট নট সরি, বাংলাদেশে কি আদৌ কোনো ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি আছে? গড়ে উঠেছে? না গড়ে ওঠার কোনো ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে? এখানে কেউ কাউকে বড় হতে দিতে চান না। অধিকাংশ ডিজাইনার ভারত আর পাকিস্তানের ডিজাইন কপি করে নিজেদের ‘নতুন নতুন সংগ্রহ’ আনেন। কোনো মৌলিক কাজ নেই। ইনটেলেকচুয়াল, এথিক্যাল জায়গাটা প্রায় শূন্য। কাদা–ছোড়াছুড়ি আর বাগড়া দেওয়ার বেলায় সবাই আছেন! আমি যদি বলি, বাংলাদেশে খুব ভালো কাজ হচ্ছে, পেশাদার ইন্ডাস্ট্রি—সেটা ভুল হবে, মিথ্যা হবে, অন্যায় হবে।
ভারতে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কী ধারণা?
ওরা সবাই বিবি রাসেল আর রুবি গজনবীকে চেনেন। রুবি আন্টি তো আর নেই। এরপর কী হবে? এরপর আর কোনো নাম নেই, যাঁর কাজ সীমানা ছাড়িয়েছে। আমি হয়তো একটা ‘প্রিভিলেজড’, ‘সেফ’ জায়গা থেকে কথাগুলো বলছি, কেননা এখান থেকে আমার কিছু পাওয়ার নেই। কিছু হারানোরও নেই। তবে কথাগুলো তো সত্য। কাউকে না কাউকে তো বলতেই হবে। লেজুরবৃত্তি না করে এখানে কাজ পাওয়া যায় না। আর এক জামদানি বেচে আর কত? আমরা জামদানি, নকশি কাঁথায় আটকে গেছি। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন পণ্যের ভেতর কেবল জামদানিটাই ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে ভালো হয়। আপনি দেখবেন, বাংলাদেশের প্রতিটি ফ্যাশন শোতেই হাতে গোনা কয়েকটা মুখ। একই মুখ। এমনকি দর্শকও একই! একই দামে মাসাবা আর বাংলাদেশের একটা ব্রান্ডের পোশাক পাওয়া যাবে। দুই মাস পরার পর বাংলাদেশের পোশাকটা ছিঁড়ে যাবে, নাহলে রং উঠে যাবে, নাহলে উজ্জ্বলতা হারাবে। আমি কেন আমার হার্ড আর্নড মানি দিয়ে ভালো কিছু কিনব না? কেউ যদি ভারতে গিয়ে শপিং করেনই, তাঁকে গালাগাল করা তাই অন্যায়। আমাদের ওই মার্কেটই তো নেই। মার্কেট থাকলে আপনি বলতে পারতেন দেশপ্রেম নেই! আমি কথাগুলো বলেছি, কারণ, আমার খুব কষ্ট হয়। কেননা, আমি আমার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সর্বোচ্চ মঙ্গল চাই। তাই আমার মতো সবাইকে স্পাইরাল অব সাইলেন্স ভেঙে সমস্যাটাকে আগে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। তবেই একে একে সমাধান হবে।
বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলো আপনাকে কাজের অফার দেয়নি?
হ্যাঁ। তবে আমাকে এ–ও বলা হয়েছে, ‘তোমাকে ‘কোরাম মেইনটেইন’ করতে হবে। যোগাযোগ রাখতে হবে।’ আমি বলেছি, ‘আমি বাসায় আমার তিন কুকুর এলাচ, দারচিনি আর ট্রাফলকে নিয়ে খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, ভালো আছি।’
বাংলাদেশে যেসব কাজ করেছেন, সেগুলোর অভিজ্ঞতা কেমন?
খারাপ না। কিছু কাজ তো করেছি। তবে এখানে আমি অনেক বেশি বুলিংয়ের শিকার হয়েছি। ভারতে যে একেবারেই হইনি, তা নয়। তবে ওরা কাজটা অনেক পেশাদারত্বের সঙ্গে করে। আমাকে কীভাবে উপস্থাপন করবে, এই শুটের পর আমি নিজের ইমেজ নিয়ে ক্রাইসিসে পড়ব কি না, এগুলো নিয়ে ভাবতে হয় না। ওরা বলে, ‘অতিথি দেব ভব’ মানে হলো ‘গেস্ট ইজ গড’। ওরা আসলেই আমাকে সেভাবে ট্রিট করেছে। আর ওরা যে পর্যটন খাতে এত ভালো করছে, এর পেছনেও এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আপনি অনিরাপদ বোধ করেন না।
বাংলাদেশের তিনটা ভালো ব্র্যন্ডের নাম বলেন।
‘ডাক্কা’ (Dacca) ব্র্যান্ডটা ভালো লাগে। ওরা অনেক মজার কাজ করে। এক্সপেরিমেন্টাল। ‘মুক্তা’ থেকে আমি অনেক কিছু নিয়েছি। মডার্ন কাজ করে। এথনিক কিছু না। আর আফসানা ফেরদৌসি আমাকে কয়েকটা কাস্টমাইজড পোশাক বানিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো আমি যে রকম চেয়েছি, একদমই সে রকম। আমি আসলে সিডনি থেকে (অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য ছিলেন বেশ কয়েক বছর) ঢাকায় ফেরার পর ঠিক করেছিলাম যে কেবল দেশি কাপড়ের পোশাক পরব। কিন্তু পারিনি, কয়েক মাস পরার পর আর তেমন কিছু পাইনি। আমার যে কী খারাপ লাগে আমার দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য। আই উইশ আই কুড চেঞ্জ!
ভারতের মূল ধারার বাইরে ভালো তিনটা ফ্যাশন ব্র্যান্ডের নাম বলেন।
শপ ডাউন (Shop Dawn)। ওদের এমন কিছু নেই যে আমি পরিনি। ইজি (Iszi)। ওরা মূলত সুইমস্যুটের জন্য জনপ্রিয়। আর হিউম্যান (Hueman)।
শীতে আপনি ত্বকের, চুলের যত্ন নেন কীভাবে?
আমি কান্না করি। আর কিছুই করার থাকে না। কেননা, আমার ত্বক রুক্ষ হয়ে যায়। চুল ফেটে যায়। প্রায় কোনো কিছুতেই কাজ হয় না। ভাবছি এমন কোথাও চলে যাব যেখানে শীত কম। শীতকালটা সেখানে কাটিয়ে তারপর ফিরব। তবে সাধারণত শীতকালে আমি ত্বকে আর চুলে তেল মাখি। সপ্তাহে একবার চুলে হট অয়েল থেরাপি করি। তবে তেল মেখে কখনো ঘুমাই না। আধা ঘণ্টা পরে শ্যাম্পু করে ফেলি। যেসব বিউটি পণ্য ব্যবহার করি, নিশ্চিত করি যে এর উপাদানগুলো ক্ষতিকর নয়। হারবাল পণ্য ব্যবহারের চেষ্টা করি। ঠিকমতো মেকআপ তুলি। সুইমিংপুলের ক্লোরিন পানিতে গোসলের সময় সুইমিং ক্যাপ পরি। এই তো।
২০২৩ সালে তো আপনি বোধ হয় প্রতি মাসেই ভারতে গেছেন?
হ্যাঁ, এই ডিসেম্বরেও যাব। ওহহো, এক মাস বাদ গেছে। কেননা, ওই মাসে পাসপোর্ট যুক্তরাজ্যের ভিসার জন্য জমা ছিল। প্রতিবার একাধিক শুট করে এসেছি। আগামী বছর আমি চেষ্টা করব আরও বেশি আন্তর্জাতিক কাজ করতে। হয়তো ইউরোপ বা অন্য কোথাও।