ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে ডিজাইনারদের সঙ্গে নবীনদের দাপটও দেখা গেছে
কোভিডের স্থবিরতা কাটিয়ে দুই বছর পর আবার মহাসমারোহে ফিরল ল্যাকমে ফ্যাশন উইক। মুম্বাইয়ের জিও ওয়ার্ল্ড কনভেনশন সেন্টারে বসেছিল এবারের আসর। ১২ থেকে ১৬ অক্টোবর পাঁচ দিনে নামীদামি ডিজাইনারদের সঙ্গে নবীনদের দাপটও দেখা গেছে। বরাবরের মতোই বিভিন্ন নকশার পোশাক পরে র্যাম্প আলোকিত করেছেন একঝাঁক বলিউড তারকা। ডিজাইনারদের ব্যতিক্রমী আয়োজন, তারকাদের দ্যুতি, দেশ-বিদেশের ফ্যাশনপ্রেমীদের রংবেরঙের পোশাক—সব মিলিয়ে জমজমাট ছিল ফ্যাশনের এই মহোৎসব।
সূচনার রাত
ডিজাইনার অনামিকা খান্নার পোশাক দিয়ে শুরু হয় এবারের ল্যাকমে। আলোর ঝরনা, আগুনের ফুলকির মধ্যে তাঁর নকশা করা পোশাক পরে জিও ওয়ার্ল্ড সেন্টারের ‘ফাউন্টেন অফ জয়’-তে হেঁটেছিলেন মডেলরা। অনামিকার ‘একে-ওকে’ শিরোনামের সংগ্রহে ছিল স্ট্রিট পোশাকের বৈচিত্র্য। ছিল র্যাপ পোশাক, পাজামা সেট, জ্যাকেট আর সাদা কুর্তার বাহার। অনামিকার আয়োজনে নজর কেড়েছিল থ্রিডি ফুলের নকশা।
নবীনের কেতন
ল্যাকমের আসরে প্রতিবছরই একঝাঁক নবীন ডিজাইনারদের সঙ্গে পরিচয় করায় ‘আইএনআইএফডি’। এবারও ‘জেন নেক্সটের’ মাধ্যমে বেশ কিছু নবাগত এবং প্রতিভাবান ডিজাইনারকে নিয়ে এসেছিল এই ফ্যাশন প্রতিষ্ঠান।
ডিজাইনার অসীম কাপুর আর পূজার ‘আমবি’ সংগ্রহ সাধুসন্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। আয়োজনে ছিল ক্রেপ, মাশরুম টুইল, অ্যাপ্লিক, জারদৌসি আর সূক্ষ্ম জরির কাজ। নবীন ডিজাইনার সোমিয়া গোয়েল ‘নিউ লাইট’ সংগ্রহের মাধ্যমে ভেগান ফেব্রিক, পিস সিল্ক, কাপ্রো, ব্লেন্ড ফেব্রিকের ওপর পাশ্চাত্য আর বেশ কিছু শাড়ি প্রদর্শন করে।
টেকসই ফ্যাশনের দাপট
ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে প্রতিবছর উদ্যাপিত হয় ‘সাসটেইনেবল ফ্যাশন ডে’। এবারও ব্যতিক্রম ছিল না। এদিন ল্যাকমের প্রাঙ্গণজুড়ে ছিল সাবেকি শিল্পকলা, হাতে বোনা তাঁত, হস্তশিল্পের বাহার। ডিজাইনার স্বাতী কাপুর গ্রিক দেবতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ভেনাস’ শিরোনামের সংগ্রহ নিয়ে মঞ্চে এসেছিলেন। পোশাকে রঙের জন্য ব্যবহার করেছিলেন বেদানাসহ আরও নানা প্রাকৃতিক উপাদান। ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম ওজনের হালকা চান্দেরি, সেল্ফ স্ট্রাইপ চান্দেরি, মোলায়েম খাদি, মূল কাপড়ের ওপর ব্লক প্রিন্ট, হাতে তৈরি এমব্রয়ডারি, পুঁতির বাহার তুলে ধরেছিলেন স্বাতী।
‘জামবান জার্নাল ২.০’–তে জামদানি আর বাঁধনির মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন ডিজাইনার ঋদ্ধি জৈন।
ডিজাইনার দীক্ষা খান্না হাতে বোনা চান্দেরি, খাদি ডেনিমের মিলনে ওয়েস্টকোট, ঘরে পরার রোব, শর্টস, চাপা পেনসিল স্কার্ট, আরামদায়ক জ্যাকেট, ক্রপড ব্লাউজের বাহারি আয়োজন রেখেছিলেন।
বিচ আর সফরকালীন ফ্যাশন
সমুদ্রসৈকতে হালকা আর রঙিন পোশাকের এক সুন্দর আয়োজন রেখেছিলেন ডিজাইনার রেবি জিন্দাল। তাঁর করা পোশাকের নকশায় দেখা গেছে ফরাসি চেক আর পদুচেরির ক্যাকটিশিল্প। রেবির ভান্ডারে এমনকি সমুদ্রতটে বিয়ের জন্য কনের পোশাকও ছিল। পুরুষদের সমুদ্রতটের পোশাক হিসেবে এনেছিলেন ফুলেল নকশার রঙিন শার্ট, শর্টস, সমুদ্রের শহরে পরার রোব, টিউনিক আর লুঙ্গি।
ডিজাইনার ইশা আমিনের সংগ্রহ ‘আফ্রো রাপসোডি’ দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত। তিনি পরিবেশন করেছিলেন ভ্রমণকালীন পোশাকের এক বর্ণাঢ্য সংগ্রহ।
ডিজাইনার আবির এন নানকি ফ্লুইড অরগেঞ্জা আর সিল্ক ক্রেপের ওপর থ্রিডি এমব্রয়ডারি, রাজস্থানের নানা প্রাকৃতিক উপাদানকে মোটিফ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। এই ডিজাইনার তাঁর ক্যানভাসে ব্লাশ পিঙ্ক, পাওডার ব্লু, ব্রাউন আর বেজ রং ব্যবহার করেছেন। তাঁর সম্ভারে আরও ছিল প্লাস সাইজের বিকিনি।
এক নয়নাভিরাম আয়োজন রেখেছিলেন ডিজাইনার রীনা সিং। তার সংগ্রহে ছিল গরমে আরামদায়ক আর ভ্রমণ উপযোগী পোশাকের বৈচিত্র্য। সুতি, সুতি সিল্ক, কোটা, লিনেন, এমনকি জামদানিকে সুতি এবং সুতি সিল্কের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক অভিনব কাপড়ের জন্ম দিয়েছেন রীনা। ব্লক প্রিন্ট নিয়ে নানা পরীক্ষা–নীরিক্ষা করেছেন তিনি।
এক রাজকীয় আয়োজনের মাধ্যমে ডিজাইনার শান্তনু-নিখিল উন্মোচন করেন দাওয়াত এবং উৎসবের পোশাক। তাঁদের আয়োজনে নজর কেড়েছিল ডোরি কাজের মধ্যে বারাক লেস এমব্রয়ডারি, ক্রিস্টাল আর পাথর খচিত লেহেঙ্গার বাহার।ডিজাইনার অঞ্জু মোদির ‘দময়ন্তী’ সংগ্রহ যেকোনো প্রজন্মকে আকর্ষণ করবে। ভারতের সাবেকি নানা শিল্পকলাকে আধুনিকতার রঙে রাঙিয়ে তুলেছিলেন তিনি। ডিজাইনার পায়েল সিংঘলের সংগ্রহের লেহেঙ্গা, গাউন, কলিদার সরারা, চোলি, রাফেলড ব্লাউজের ওপর জারদৌসি, অ্যাপ্লিক, মুকাইশ, উলের সুতার কাজ ছিল প্রশংসনীয়। ডিজাইনার গৌরব গুপ্তা আগামী প্রজন্মের দাওয়াতের পোশাকের এক অভিনব প্রদর্শন করেছেন। তাঁর এই আয়োজনে কালো, গাঢ় নীল, সাদা পোশাকের ওপর সিকোয়েন্স, গ্লিটারের কারুকাজ ছিল অনবদ্য। ডিজাইনার আয়শা রাওয়ের আয়োজনে পার্টি পোশাক হিসেবে ছিল সিকোয়েন্সের কাজ করা ভারী গাউন, স্লিট গাউন, শিফন শাড়ি, বডি হাগিং গাউন, ব্রোকেটের ট্রাউজার-কোট, ঘেরওয়ালা গাউন, কনের জন্য লেহেঙ্গা-চোলি, ছেলেদের জন্য প্যান্ট আর সিকোয়েন্স কাজের শার্ট, সিকোয়েন্স কাজের প্রিন্স কোট-প্যান্ট, প্যান্ট-শার্ট, জওহর কোট। ডিজাইনার শ্যামল-ভূমিকার ‘ব্লুমস অফ প্যারাডাইস’ সংগ্রহে ছিল হাতে বোনা র সিল্ক, মটকা সিল্ক, স্বচ্ছ সিল্ক অরগেঞ্জা, হাতে ডাই করা ভেলভেটের ওপর রেশম আড়ি, সিল্ক জারদৌসি, মেটাল থ্রেড পিটা, বিড ওয়ার্ক, সিল্ক থ্রেড, ক্রিস্টাল, মুক্তো, বিড, হাতে তৈরি এমব্রয়ডারির বৈচিত্র্য। শ্যামল-ভূমিকা ইংলিশ রোজ পিঙ্ক, মিউটেড আইভরি, ডিপ পাওডার ব্লু, ডাস্টি মিন্ট, অর্কিড, লুনার গ্রে, মিডনাইট ব্লুসহ আরও নানা রঙে তাদের প্রদর্শনকে রঙিন করে তুলেছিলেন। দিওয়ালি উপলক্ষে ‘পলাশ’ আয়োজনে লাল রঙের দাপট দেখিয়েছেন ডিজাইনার সংযুক্তা দত্ত। এ ছাড়াও ব্যবহার করেছেন গেরুয়া, কালো, বেগুনিসহ নানা উজ্জ্বল রং।
ল্যাকমের শেষ রাতে ফ্যাশন ডিজাইনার রাজেশ প্রতাপ সিংয়ের পোশাক পরে র্যাম্পে হেঁটেছিলেন বলিউড নায়িকা ম্রুণাল ঠাকুর। ম্রুণালের পরনে ছিল কলারওয়ালা সাদা ফুল হাতা শার্ট, আর শাড়ি প্যান্ট। রাজেশের সাদা-কালো এই প্রদর্শনে ছিল মনোক্রোমোটিক প্যালেট থেকে প্যাস্টেল রঙের ব্যবহার।