মস্কোর স্থাপত্য নকশা দেখতে দেখতে চোখে একসময় ধাঁধা লেগে যায়। তার ওপর সামনেই আবার বড়দিন। আলোয় সেজেছে পুরো রাজধানী। বিকেল সাড়ে চারটা বাজলেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় জ্বলে ওঠে হাজারো আলো। এ যেন ঠান্ডার শহরে বিষণ্নতা দূর করার আরেক উপায়। ব্রিকস+ফ্যাশন সামিটের চতুর্থ এবং পঞ্চম বা শেষ দিনের সব কটি আয়োজনই ছিল এই শহরের ঝলমলে আর জমকালো পরিবেশের মতো। ৫ দেশের ৫ ডিজাইনার তুলে ধরলেন নিজেদের ভাবনা।
মিসরের হানি এল বেহরি ও দক্ষিণ আফ্রিকার ডেভিড ক্লালের ডিজাইন করা পোশাকে ছিল জমকালো নকশা। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার আলড্রে ইনড্রায়ানা ও ব্রাজিলের ডিজাইনার লুকাস লিওর পোশাকে চোখে পড়ল একধরনের নাটকীয়তা। ক্ল্যাসিক আর অভিজাত শীতের কোট নিয়ে মঞ্চে আসেন সার্বিয়ার ডিজাইনার ইভানা বাটাকোভিক।
ফ্যাশন সামিটের চতুর্থ দিনে একে একে হাজির হন আলড্রে ইনড্রায়ানা, হানি আল বেহরি ও ডেভিড ক্লালে।
ছোটবেলা থেকেই কল্পনার জগতে থাকতে পছন্দ করতেন আলড্রে। ছোটবেলার সেই ড্রাগনই থ্রিডি প্রিন্টের মাধ্যমে তাঁর পোশাকের ওপর বসে গেছে। হাতে বোনা সিল্ক ও সুতির কাপড়ের ওপর সোনার সুতার কাজ আছে, জানালেন আলড্রে। আরামদায়ক কাট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। তবে কিছু পোশাককে নির্দিষ্ট আকার দেওয়ার জন্য কর্সেটের ব্যবহার করা হয়েছে। তরুণদের উদ্দেশ্য করেই মূলত বানানো হয়েছে পোশাকগুলো।
অন্যদিকে ফ্যাশন শো শেষে হানি এল বেহরি জানালেন, সবাই এবার তাঁকে একটু ভিন্ন কিছু করার পরামর্শ দিয়েছিল। তবে জমকালো নকশার প্রতি তাঁর সব সময়ের আগ্রহ, এবারও তা-ই করেছেন, সামনেও তা-ই করবেন। মা ও দাদির কাছ থেকে হাতের কাজ শিখেছেন এই ডিজাইনার। পোশাকের ওপর সূক্ষ্ম হাতের কাজ করতে কখনো কখনো নিজেও বসে যান। টুল, মসলিন, টাফেটা সিল্ক, শিফনের কাপড় দিয়ে বানানো সান্ধ্য পোশাকগুলোর ওপর হানি আল বেহরি বসিয়েছেন সরোভাস্কি পাথর ও ক্রিস্টাল।
শরৎ-শীত, বসন্ত-গ্রীষ্ম—এই চার ঋতুতে পরার মতো পোশাক নিয়ে সংগ্রহ সাজিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ডিজাইনার ডেভিড ক্লালে। ‘লেট লাভ ব্লুম’ শিরোনামের পোশাকগুলো নিয়ে ২০ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। বলছিলেন, ‘ব্রিকস+ফ্যাশন সামিটে দেখাতে চাইছে, আমরা কী করি, কিসে বিশ্বাস করি।’ এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে, উপকরণ ও সংস্কৃতির আদানপ্রদান হবে, গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক সংযোগ—এমনটাই তার প্রত্যাশা।
ফ্যাশন শোয়ের মঞ্চে ডেভিডের নকশা করা পোশাকে দেখা যায় ডাচেস স্যাটিন, শিফন, লেস, টেনসিল টুলস, অরগাঞ্জা, চামড়া ও ব্রোকেডের ব্যবহার। বারোক স্টাইল অনুসরণ করেছেন তিনি। এসব পোশাকে অফিসে যেমন যেতে পারবেন, তেমনি অফিসে থেকে সরাসরি কোনো আমন্ত্রণেও চলে যাওয়া যাবে। ডেভিড ক্লালে মনে করেন তিনি পোশাক নয়, বিক্রি করেন অনুভূতি। ‘আমাকে সুন্দর লাগছে’—পোশাক গায়ে দিয়ে মনকে যদি এই অনুভূতি আচ্ছন্ন না করে, তবে নাকি তাঁর ডিজাইনার হিসেবে নিজেকে মনে হয় ব্যর্থ।
শেষের দিন নিজেদের নকশা করা পোশাক নিয়ে মঞ্চে হাজির হন সার্বিয়ার ডিজাইনার ইভানা বাটাকোভিক ও ব্রাজিলের ডিজাইনার লুকাস লিও।
বাটাকোভিক ব্র্যান্ডটি মূলত শীতের জন্য কোট তৈরি করে। কোনো নির্দিষ্ট চলতি ধারা অনুসরণ করে না এই ব্র্যান্ড। নীল, সাদা, ছাই কিংবা মেটে রঙের মতো অভিজাত রঙের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করেন ইভানা।
পাঁচ দিনের আয়োজনের সর্বশেষ ফ্যাশন শোতে সিরামিক ও কাচমিশ্রিত কাপড় ব্যবহার করেছেন লুকাস লিও, পোশাকটি যেন নড়বড় না করে। যেকোনো বিশেষায়িত পোশাক (ডিজাইনারস কালেকশন) বানানো শুরু করার আগে ছয়জন ব্রাজিলিয়ান শিল্পীকে বেছে নেন তিনি, যাঁরা পোশাকে চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার একটা চিত্র তুলে ধরেন। লুকাস লিওর এবারের নকশা মূলত ভবিষ্যতের জীবনের একটা চিত্র তুলে ধরেছে। সাদার চারটি শেডে তিনটি ভিন্ন পোশাক উপস্থাপন করেছেন তিনি।
রাশিয়ার মস্কোতে গত ২৮ নভেম্বর শুরু হয়ে ২ ডিসেম্বর শেষ হলো ব্রিকস+ফ্যাশন সামিট। পাঁচ দিনের এই আয়োজন একযোগে চলেছে ফ্যাশনবিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা, ব্যবসায়ী-ক্রেতা-ডিজাইনারদের সমাবেশ, কর্মশালা, ফ্যাশন শোসহ নানা কিছু। ব্রিকসের পাঁচ দেশ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন ৫৫টি দেশ থেকে আসা ডিজাইনার, বক্তা, সাংবাদিক ও পেশাজীবীরা।