রানির বিয়ের পোশাক তৈরির সময় দোরে কেন পাহারা বসেছিল

রানির ফ্যাশন নিয়ে ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে সারা হ্যারিস লিখেছেন, ‘আপনি একবার ভাবুন, একটা মানুষ তাঁর দীর্ঘজীবনে কোনো দিন ফ্যাশনের ক্ষেত্রে এতটুকু ভুল করেননি। আপনি আতশি কাচ ধরেও তাঁর একটা ভুল ধরতে পারবেন না। প্রতিবার তিনি সঠিক ফ্যাশনটাই বেছে নিয়েছেন। “অতিপোশাক, মিতপোশাক বা ভুলপোশাক”—এই তিন বিশেষণ কোনো দিন তাঁর পোশাকের জন্য প্রযোজ্য নয়। পোশাকের ক্ষেত্রে তিনি সব সময় যথাযথ, আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।’ এদিকে ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর রানি ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়ে নিয়ে পেজ সিক্সে বলা হয়েছে, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাশন নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে যদি কোনো আলোচনা হয়, তাহলে সেটি রানির বিয়ের পোশাক নিয়ে হয়েছে। সেটি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে স্টাইলিশ রাজকীয় বিয়ে।’ জেনে নেওয়া যাক, ৭৫ বছর আগে রানির বিয়ের পোশাকের খুঁটিনাটি নিয়ে।

প্রিন্স ফিলিপ ও রানি এলিজাবেথের প্রথম দেখা ১৯৩৯ সালে। সে সময় এলিজাবেথ ১৩ বছরের কিশোরী, এদিকে ১৮ বছরের প্রিন্স ফিলিপ তখন ব্রিটানিয়া রয়্যাল নেভাল কলেজের ক্যাডেট। রানিই গ্রিসের ক্ষমতাচ্যুত রাজার ভাইপো প্রিন্স ফিলিপের প্রেমে মজেছিলেন।
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে
অবশ্য বিয়ের জন্য তাঁদের অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ আট বছর—১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। মাঝে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দুজনের মধ্যে চলছিল চিঠি বিনিময়। ফিলিপ সে সময় রয়্যাল নেভিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁর নীল চোখ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন এলিজাবেথ।
রানির ব্যক্তিগত ডিজাইনারদের ভেতর প্রথমেই আসবে স্যার নরম্যান হার্টনেলের নাম। ১৯৪৭ সালে প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে ২১ বছর বয়সী রানির বিয়ের পোশাকটি তিনিই বানিয়েছিলেন। ক্রিস্টাল, হীরা ও ১০ হাজার ছোট ছোট মুক্তা বসানো ডাচেস সাটিন ও সিল্কের মিশ্রণের কাপড় দিয়ে তৈরি হয়েছিল পোশাকটি, ছবিতে স্কেচে রানির বিয়ের পোশাক
চীন থেকে আনা হয়েছিল বিয়ের পোশাকের কাপড়ের কাঁচামাল। আর মুক্তাগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ বিয়ের পোশাকের ট্রেনটি ইতালীয় চিত্রশিল্পী সান্দ্রো বতিচেল্লির বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্ম ‘লা প্রিমাভেলা’ থেকে অনুপ্রাণিত। সাটিনের ট্রেনটি ছিল ১৩ ফুট লম্বা। এটিই ছিল পোশাকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক
এই সেই চিত্রকর্ম, সামনে দাঁড়িয়ে প্রিন্স চার্লসের দ্বিতীয় স্ত্রী ক্যামিলা
বিয়ের পোশাক তৈরির জন্য অনেকেই ৯-১০ মাস পর্যন্ত সময় নিয়ে থাকেন। কিন্তু দ্য রয়্যাল কালেকশন ট্রাস্টের তথ্যানুসারে, রানির বিয়ের পোশাকের ডিজাইন চূড়ান্ত হয় আগস্টে গিয়ে। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামাজিক পরিবর্তন সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছিল রাজপরিবার, ছবিতে রানির বিয়ের পোশাকের একটি রেপ্লিকা
‘পিপল’ ম্যাগাজিনকে নরম্যান হার্টনেল বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের সেই সময়ের অনেক নামকরা, প্রভাবশালী ফ্যাশন ডিজাইনাররা রানির বিয়ের পোশাকের ডিজাইন করেছিলেন। কিন্তু আমি যা করেছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল, এটাই সেরা। এটা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আর নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের পুরো মেধা-শ্রম বিলিয়ে দিই পোশাকটি বানাতে। আর বাকিটা তো ইতিহাস। আমি রানির একান্ত ডিজাইনার বনে যাই!’
রানির বিয়ের পোশাক তৈরির বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ করেন নরম্যানের কোম্পানির ৩৫০ সুবিধাবঞ্চিত নারী। এটি ছিল তাঁদের জীবনের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কাজ। তাঁদেরই একজন ১৮ বছর বয়সী বেটি ফস্টার। দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রানির পোশাক তৈরির অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘কেউ যাতে পোশাকটির ডিজাইন দেখতে বা ধারণা করতে না পারে, সে জন্য পুরো ঘরের সব দরজা-জানালা ভারী পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। আর সেগুলো যাতে উড়ে না যায় বা কেউ উঁকি দিয়ে না দেখে, এ জন্য প্রতিটি দরজা-জানালায় বাইরে থেকে পাহারা বসানো হয়েছিল। তিন মাস এ রকমই ছিল।’
এলিজাবেথ কিন্তু একেবারে বিয়ের জন্যই পোশাকটি পরেছিলেন। একবার ট্রায়াল দেওয়ারও সুযোগ পাননি। কেননা, বিয়ের দিন সকালবেলা পোশাকটি হাতে পান তিনি। আর পোশাকটি পরার আগে নাকি তিনি সেটি হাতে ধরে বসে ছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। আসলে এ বিয়ের জন্য রানি অপেক্ষায় ছিলেন। বিয়েটা আরও আগেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিয়ের সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয় আর বিয়েটিকেও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। বিয়ের পোশাক হাতে পাওয়ার পরই রানির মনে হয়েছিল, সত্যিই সেটি ঘটতে চলেছে। আর পোশাকটি যে এত সুন্দর হবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি। প্রিন্স ফিলিপও বিয়ের দিন রানিকে দেখে একাধিকবার তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করেন
বিয়ের দিন উত্তেজনা বা নার্ভাসনেস যাতে রানিকে গ্রাস না করে, এ জন্য প্রিন্স ফিলিপ একটি বিশেষ ‘ড্রিংক’ পান করতে বলেছিলেন। কিন্তু রানি সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। সম্ভবত, সেই প্রথম আর একবারই রানি নিজের সহজাত উচ্ছ্বাস জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন। আর কখনোই রানিকে ব্যক্তিগত আবেগ নিয়ে বিশ্বের মুখোমুখি হতে দেখা যায়নি