ফ্যাশনের বুননে গল্প বলেন সামি

দেশীয় লাল জামদানিতে তৈরি হয়েছিল পশ্চিমা নকশার গাউন। সেটি পরে ক্যাটওয়াক শেষে মডেল যখন ঘুরলেন, পেছনে দেখা গেল নকশিকাঁথা। কালো জমিনে গ্রামবাংলার নানা উপাদানের সঙ্গে স্পষ্ট করে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। ফ্রান্স আর বাংলাদেশ—দুই দেশের কূটনীতিক আর আমন্ত্রিত বিশেষ দর্শকদের করতালিতে মুখর হয়ে উঠল প্যারিসের পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকনটিনেন্টাল প্যারিস লা গ্র্যান্ডের বলরুম। গত ২৩ অক্টোবর ‘ফ্যাশনের রাজধানী’ ফ্রান্সের প্যারিসে উদ্‌যাপিত হলো বাংলাদেশ আর ফ্রান্সের দীর্ঘসময়ের সুগভীর বন্ধুত্ব। ফ্রান্সের বাংলাদেশ দূতাবাস আর বাংলাদেশের ফরাসি দূতাবাসের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সিকিউটিরিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিআইডিএ) যৌথভাবে এ ইভেন্টের আয়োজন করেছিল। শো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁর ওপর ভর করে ঘটেছে, তিনি আড়ংয়ের হারস্টোরির জ্যেষ্ঠ ডিজাইনার সামি আলম। বাংলাদেশের তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার সামি আলমের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপে উঠে এল এই সংগ্রহের পেছনের নানা গল্প।
রানওয়ে অন্ধকার। বাজছে জসীমউদ্‌দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’-এর চরণ। সেখানে বলা হচ্ছে দুই গ্রামের বন্ধুত্বের কথা। এই গ্রাম দুটো যেন বাংলাদেশ আর ফ্রান্স। মঞ্চ আলোকিত হলো। একে একে মডেলরা এলেন জামদানি, তাঁত, মসলিন, নকশিকাঁথা, লুঙ্গি প্রিন্টের সঙ্গে ডেনিম, লেদার, গ্যাবার্ডিনের মিশ্রণে শাড়ি, গাউন, পাঞ্জাবি, বাইকার জ্যাকেট, চাদর, স্যুট গায়ে চাপিয়ে
ছবি: ফাবৃস মালার্ড
কাপড়, নকশা, ডিজাইন আর পোশাকে ছিল ফিউশন, এ যেন বাংলাদেশ আর ফরাসি সংস্কৃতির অটুট বন্ধুত্বের এপাশ-ওপাশ
২০টি পোশাক পরে মঞ্চে আসেন ২০ জন মডেল। তাঁদের ৫ জন বাংলাদেশি—মাশিয়াত রহমান, শিরিন শীলা, মীর মারিয়াম, সিম্মি তাসপিয়া আর আফসানা স্পৃহা। আর অন্যরা প্যারিসের পেশাদার মডেল
শোয়ের কোরিওগ্রাফার ছিলেন আজরা মাহমুদ (ছবিতে সর্ব বামে) ও শোয়ের কো–অর্ডিনেটর ছিলেন দেলফিন দুরিউক্স (ডানে)
ফরাসি মডেলরা এমনভাবে এ দেশের সংস্কৃতির পোশাক পরে হেঁটেছেন, যেন বাংলার কৃষক, গ্রামের বউ, বাউলেরা প্যারিসের রাস্তায় হেঁটে চলেছেন
বাংলাদেশ আর ফ্রান্সের বন্ধুত্বের এই ফ্যাশনেবল উদযাপনে গুরুত্ব পেয়েছে ফিউশন
কোথাও ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ, আবার কোথাও নজরুল, কোথাও লিটল প্রিন্স আবার কোথাও ভিক্টর হুগোর লাইন—পুরো শো অনেকটা গ্যালাকটিক, নানান রঙে, উপস্থাপনায়, বৈচিত্র্যে যেন উঠে এসেছে মাল্টিভার্স
এই শোয়ের জন্য সামি মূলত ১৯টি পোশাকের ডিজাইন করেছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পোর্ট্রেট আঁকা পোশাকটি ছিল তাঁর প্রথম সংগ্রহ। ২০১৫ সালের ড্রেসটি প্যারিসের এই শোয়ে নিয়ে তিনি ডিজাইনার হিসেবে নিজের যাত্রাকেই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন
শোয়ের জন্য প্যারিসে একজনকে সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব দেন সামি। তিনিই সামির সঙ্গে পরামর্শ করে মডেল কাস্টিং, ফটোগ্রাফার-ভিডিওগ্রাফার নেওয়া, নেপথ্য মঞ্চ ব্যবস্থাপনা—এ সবকিছু সামলেছেন
সামির ভাষায়, ‘সব সংগ্রহ শেষে যে ফেব্রিক বেঁচে গিয়েছিল, সেটা দিয়ে কিছু একটা বানিয়ে পরে মঞ্চে উঠে পরেছি। প্রতিবার এ রকমই হয়। সংগ্রহ শেষে যা কাপড় থাকে, নিজের জন্য কিছু একটা করে ফেলি।’
সামি নিজে যে পোশাকটি পরে মঞ্চে ওঠেন, সেটিও তাঁর বানানো। ছবিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন অ্যাকাডেমিন পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফ্যাশন বিভাগের প্রধানের সঙ্গে সামি (ডান থেকে দ্বিতীয়)। ছবিটি শোয়ের শেষে তোলা
ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসেডর অব বাংলাদেশ, ম্যারি ম্যাসদুপয় সঙ্গে সামি। শো শেষে তিনি নিজেই ব্যাকস্টেজে সামির সঙ্গে দেখা করতে আসেন ও অভিনন্দন জানান
সামির ডিজাইনার হওয়াটা যেন অন্যভাবে লেখা হয়েছিল। ছোটবেলা থেকে আঁকতে ভালোবাসতেন। ‘ক্রিয়েটিভ লাইনে’ কিছু করার ইচ্ছা ছিল। ‘এ’ লেভেল শেষ করে মা-বাবার কথামতো সোজা ভর্তি হয়ে গেলেন বিবিএ পড়তে
বিবিএ পড়ার সময় টিউশনি করতেন সামি। সবকিছু ভালোই চলছিল। কিছু টাকা জমে যাওয়ায় শখের বশেই ফরাসি ভাষা শেখা শুরু করলেন। সেই সময় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ ‘লেটস গো টু ফ্রান্স’ শিরোনামে ক্রিয়েটিভ রাইটিং ও ডিজাইনের ওপর একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিজয়ীকে ফ্রান্সে দুই সপ্তাহের একটা সাংস্কৃতিক সফরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই প্রতিযোগিতায় জিতে সামি ২০১০ সালে ফ্রান্স থেকে ঘুরে আসেন। সেখানে বিশ্বের প্রায় সব দেশের ১৭০ জন তরুণ অংশ নিয়েছিলেন। ছবিতে শোয়ের মডেলদের সঙ্গে এই ডিজাইনার
মূলত এই ট্রিপই সামির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে সামি বিবিএ ছেড়ে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ভর্তি হন। স্নাতক শেষে আড়ংয়ে চাকরি করার সময় তিনি ফ্রান্সের ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন একাডেমি, প্যারিসে কনটেম্পোরারি ফ্যাশন নিয়ে স্নাতকোত্তর করেন