টি–শার্টে তুলে ধরা হচ্ছে নানা কথা ও ছবি। মডেল: লাবণ্য ও নূর, পোশাক নিত্য উপহার
টি–শার্টে তুলে ধরা হচ্ছে নানা কথা ও ছবি। মডেল: লাবণ্য ও নূর, পোশাক নিত্য উপহার

তরুণ প্রজন্ম যেভাবে টি-শার্টে নিজের কথা বলছে

তরুণদের ওয়ার্ডরোবে সবচেয়ে পরিচিত পোশাক কোনটি? তর্কাতীতভাবেই সে প্রশ্নের উত্তর টি-শার্ট। শুধু তরুণ-তরুণী নন, কিশোর-যুবক থেকে শুরু করে মাঝবয়সী, সবার ওয়ার্ডরোবের বড় একটি অংশ দখল করে আছে টি-শার্ট। তরুণ প্রজন্মের কাছে টি-শার্ট এখন আর শুধু পরিধেয়ই নয়, বার্তাবাহকও।

মূলত গরম থেকে বাঁচতেই টি-শার্টের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯ শতকের শেষ দিকে কারখানার শ্রমিকেরা কারখানার গরম থেকে বাঁচতে নিজেদের জাম্পস্যুটের হাতা কেটে ছোট করে নিতেন। আস্তে আস্তে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয় হতে থাকে এই পোশাক। সর্বস্তরের মানুষের কাছে টি-শার্টকে জনপ্রিয় করে তোলেন অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডো। পঞ্চাশের দশকে এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার সিনেমায় অধিকাংশ দৃশ্যেই তাঁকে টি-শার্ট গায়ে দেখা যায়। পরবর্তী দুই দশকে গণমানুষের পোশাক হয়ে ওঠে টি-শার্ট।

বাংলাদেশে একবিংশ শতাব্দীতে এসে টি-শার্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। তখনকার বাজারে যেসব টি-শার্ট পাওয়া যেত, তার বেশির ভাগই ছিল গার্মেন্টসের বাতিল পণ্য। সুলভ মূল্যের সেসব টি-শার্টে মিলত বিদেশি নকশা। কেমন হতো যদি বাংলাদেশি মানুষের জন্য বাংলার নিজস্ব নকশার টি-শার্ট থাকত? এই চিন্তা থেকেই যাত্রা শুরু করে ‘নিত্য উপহার’। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে দেশীয় ডিজাইনের টি-শার্ট বিক্রি শুরু করেন তাঁরা।

বর্তমানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবে টি-শার্ট বেছে নিয়েছেন। পরতে আরাম, সব আবহাওয়ায় মানানসই, সব মিলিয়ে টি-শার্টের জনপ্রিয়তাকে টেক্কা দেওয়া কঠিন। তবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের কাছে টি-শার্টের সংজ্ঞা বদলে গেছে অনেকখানি। টি-শার্ট এখন আর ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবে নয়, বরং বার্তাবাহক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। চলতি ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিলছে অভিনব সব ডিজাইন ও স্টাইল। গত কয়েক বছরে টি-শার্টের ধরনেও এসেছে বেশ পরিবর্তন। আঁটসাঁট টি-শার্টের পরিবর্তে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন ড্রপ শোল্ডার টি-শার্ট।  

টি-শার্ট এখন আর ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবে নয়, বরং বার্তাবাহক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে

ট্রেন্ডের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিনিয়তই নিজেদের আপডেট করছেন উদ্যোক্তারা। নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান বলেন, তরুণদের ফ্যাশন বদলে যাচ্ছে। বেশ কিছু উদ্যোক্তা তা মাথায় রেখেই কাজ করছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশনের সঙ্গে দেশীয় কিছুর মিশ্রণ করে ট্রেন্ড তৈরি করছেন। টি-শার্টে চোখ বোলালেই বোঝা যায়—কার কী পছন্দ-অপছন্দ, কোন দিকে হাঁটছে ট্রেন্ড। নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে টি-শার্ট তৈরি করেন কিছু উদ্যোক্তা। অনলাইনভিত্তিক পেজ বংক টি-শার্টসের কর্ণধার নাজমুল সাকিব বলেন, ‘আমাদের পেজটা গড়ে উঠেছে পশুপাখি ও মিমকে কেন্দ্র করে। আমাদের কাস্টমার বেসও তাই নির্দিষ্ট।’ তবে ডিজাইন যেমনই হোক, টি-শার্ট পরে আরাম না পেলে দ্রুতই মুখ ফিরিয়ে নেন ক্রেতা।

মূলত তুলা অথবা পলিয়েস্টার দিয়েই তৈরি হয় টি-শার্ট। তবে স্বাচ্ছন্দ্যের দিক থেকে সব সময়ই এগিয়ে আছে তুলা। শতভাগ তুলার তৈরি টি-শার্ট যেকোনো আবহাওয়াতেই মানানসই। তবে জিএসএম (জিএসএম হলো গ্রাম /স্কয়ার মিটার, সহজ করে বললে—এক স্কয়ার মিটার কাপড়ের ওজন যত গ্রাম, সেটাই তার জিএসএম । আর স্কয়ার মিটার হলো এক মিটার দৈর্ঘ্য ও এক মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট কোনো বর্গ)–এর ওপর কাপড়ের গুণমান নির্ভর করে। জিএসএম  যত বেশি, টি-শার্টের গুণগত মান তত ভালো। বেশির ভাগ টি-শার্টই ১৬০ থেকে ২০০ জিএসএমে তৈরি হয়। বংক টি-শার্টসের স্বত্বাধিকারী নাজমুল সাকিব আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের টি-শার্টে নিট অ্যান্ড ডায়িং ফেব্রিক ব্যবহার করে থাকি। এসব টি-শার্ট আগে থেকেই সিলিকন ওয়াশ দেওয়া থাকে। এতে ক্রেতা প্রথমবার পরিষ্কার করলে তা থেকে রং বের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।’

প্রতিবাদ, দেশপ্রেম—সবকিছুই ঠাঁই পাচ্ছে টি-শার্টে

তরুণদের কাছে টি-শার্ট এখন হয়ে উঠেছে একটি ক্যানভাস। সেই ক্যানভাসে নিজের পছন্দসই নকশা তুলতে পারছে তারা। নিত্যনতুন মিম, আর্ট স্টাইলে সীমাবদ্ধ থাকছে না তারা। বরং যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, রসবোধ, প্রতিবাদ, দেশপ্রেম—সবকিছুই ঠাঁই পাচ্ছে টি-শার্টে। কেউ কেউ আবার নিজের পছন্দের ব্র্যান্ড, খেলোয়াড়, টিভি সিরিজ-সিনেমা-কমিক বুকের চরিত্র, চরিত্রগুলোর ডায়ালগ দিয়ে তৈরি করিয়ে নিচ্ছে টি-শার্ট। ভক্তকুলও তা কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে বললে ভুল হবে, গত কয়েক বছরে টি-শার্ট বাজার পুরোপুরি অনলাইননির্ভর, বিশেষ করে করোনার পর অনলাইনভিত্তিক টি-শার্ট পেজের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণ। এর মধ্যে কেউ কেউ দোকান দিলেও বেশির ভাগ কেনাবেচাই চলে অনলাইনে। বেচাকেনা অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় তরুণদের কাছে অপশনও অনেক। এক পেজে পছন্দ না হলেই অন্য পেজে ঢুঁ মারা যাচ্ছে, দাম ও মানে সন্তুষ্ট করতে পারলেই ক্রেতাকে ধরে রাখতে পারছেন উদ্যোক্তারা। উদ্যোক্তাদের মধ্যেও তাই লড়াইটা অনেক বেশি, সুলভ মূল্যে ভালো মানের ও নকশার পণ্য ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার লড়াইটাই তাদের মধ্যে বেশি। তবে তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে কাস্টমাইজড টি-শার্ট। কিছু অনলাইন পেজ তাদের ক্রেতাদের জন্য কাস্টমাইজড টি-শার্ট তৈরি করার অপশনও রেখেছে। ক্রেতারা চাইলেই নিজের পছন্দসই ডিজাইন দিয়ে টি-শার্ট বানিয়ে নিতে পারেন। নিজের পছন্দসই নকশা গায়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোতে যে আনন্দ, তা যেন টি-শার্টও দিতে পারে।