গত বছরের প্রতিটি ফ্যাশন উইকে ভ্যালেন্টিনো মানেই ছিল গোলাপির সমাহার। প্যারিস, লন্ডন থেকে মিলান; শীত হোক কিংবা গ্রীষ্ম; ২০২২ সালে ভ্যালেন্টিনো মানেই ছিল গোলাপি। রানওয়ে, হল থেকে শুরু করে বিখ্যাত লা ক্যারু দ্য টম্পের পিলার; ভ্যালেন্টিনোর প্রতিটি অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল গোলাপিতে। শুভেচ্ছাদূত থেকে শুরু করে র্যাম্প, পুরোটাইও ছিল গোলাপিতে মোড়ানো। এর আগের বছরও ভ্যালেন্টিনোর ডিজাইনে ছিল বিভিন্ন রঙের সমাহার। লোগো ডিজাইন ছিল তাদের মূল প্রতিপাদ্য। কিন্তু ২০২২ আসতে না আসতেই গোলাপি রংটি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে ভ্যালেন্টিনোয়।
.লোগো ডিজাইন পাশে সরিয়ে সম্পূর্ণ এক রঙের এই ডিজাইনার ড্রেস বিপ্লব ঘটিয়েছে ফ্যাশন–দুনিয়ায়, যার পুরোটাই এসেছে ভ্যালেন্টিনোর নতুন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর পিয়ারপাওলো পিক্কোলির হাত ধরে। পিক্কোলি, তাঁর ডিজাইন টিম ও কালার স্পেশালিস্টদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেছেন ‘ভ্যালেন্টিনো পিঙ্ক পিপি’ নামক গোলাপির নতুন এক শেড। গত এক বছরে এটিই হয়ে উঠেছে ভ্যালেন্টিনোর ট্রেডমার্ক।
ভ্যালেন্টিনোর হাত ধরে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে পুরো ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতেই। আগে যেখানে বাহারি ডিজাইন ও রঙের সংমিশ্রণে নিজেদের হাজির করত ফ্যাশন হাউসগুলো, সেখানে ২০২২ সালে এসে সম্পূর্ণ একরঙা ডিজাইনের প্রভাব সর্বত্র। স্ট্রিটওয়্যার ব্র্যান্ড সুপ্রিমের কথাই ধরা যাক। সূচনালগ্ন থেকেই চকচকে লাল রং তাদের ট্রেডমার্ক। শপিং ব্যাগ, শার্ট থেকে শুরু করে স্কেটবোর্ড—সব জায়গায়ই তাদের লালের প্রভাব। আগে তাদের ডিজাইনার প্রোডাক্টে ডিজাইনের তারতম্য থাকলেও যতই বছর এগিয়েছে, ততই রঙের প্রভাব বেড়েছে পোশাক–আশাকে।
ভ্যালেন্টিনো-সুপ্রিমের অনেক আগে থেকেই এই রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে ইতালীয় ব্র্যান্ড বোতেগা ভেনেতা। ২০২১ সালের স্প্রিং ফ্যাশন উইক থেকে সবুজ রংটি তারা বেছে নিয়েছে ব্র্যান্ডের রং হিসেবে। এমনকি ‘বোতেগা গ্রিন’ নামে নিজেদের সবুজ রংকে ট্রেডমার্কও করে নিয়েছে তারা। এখানেই থেমে থাকেনি বোতেগা। ২০২২ সালের শুরুতে গুগল প্লে স্টোরে নিজেদের অ্যাপ তৈরি করেছে শুধু সবুজ রং দিয়ে। না আছে ব্র্যান্ডের লোগো, না ব্র্যান্ডের নাম। অর্থ একটাই, আমাদের এভাবেই চিনে নাও।
কিন্তু হঠাৎই ডিজাইনার ড্রেসে ব্র্যান্ডগুলোর লোগো থেকে রঙে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যটা কী? বিজ্ঞাপনী সংস্থা ওয়ান্ডারম্যান থমসনের এডিটর এমিলই সাফিয়ান-ডেমার্সের মতে, রং বর্তমানে ভিজ্যুয়াল শর্টহ্যান্ড হিসেবে কাজ করে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষ সবকিছুর সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে চায়। যে কারণে ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজেদের রং প্রতিষ্ঠা করতে পারা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
এ ছাড়া মানুষকে আকৃষ্ট করতে নিদির্ষ্ট রঙের চেয়ে বড় মার্কেটিং নেই বললেই চলে। রং যেমন সহজে মানুষের মনে গেঁথে যায়, তেমনই লোগোর থেকে বেশি পরিচিতিও পাওয়া সম্ভব। যে কারণে দিন দিন লোগোর থেকে ব্র্যান্ডের ডিজাইনে প্রাধান্য পাচ্ছে রং। একটা সময় রং ছিল ডিজাইনের অংশ। ধীরে ধীরে যত দিন যাচ্ছে রংই হয়ে উঠছে ফ্যাশন ব্র্যান্ডের ‘মুখচ্ছবি’। নিত্যনতুন ডিজাইনার ড্রেসের জায়গাটা দখল করছে এক রঙের পোশাক।
ঐতিহাসিকভাবেই দুনিয়ার অনেক ব্র্যান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের নিজস্ব রং। আধুনিক সময়ে সেই রংকেই নিজেদের পরিচিতি হিসেবে তৈরি করছে তারা। হার্মিস তাদের ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই নির্ভরশীল কমলা রঙের ওপর। অন্যদিকে সেই ১৮৪৫ সাল থেকে টিফানির ট্রেডমার্ক রবিন-এগ ব্লু। টিফানির সঙ্গে এই রং এতটাই ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে গেছে যে ১৯৯৮ সালে এই রংকে ‘টিফানি ব্লু’ নামে ট্রেডমার্কও করে নিয়েছে তারা।
পুরোনোদের দেখাদেখি নতুন ব্র্যান্ডগুলোও একই পথে হাঁটছে। এনএফএল সটার টম ব্র্যাডির নতুন ফ্যাশন হাউস ব্র্যাডি নিজেদের রং হিসেবে বেছে নিয়েছে নেভি ব্লু। শুরু থেকেই নিজেদের জন্য বিশেষ রং বেছে নেওয়া শুধু তাদের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ বাড়ায়নি, সঙ্গে নিজেদের নিয়ে গেছে উদ্দিষ্ট ভোক্তার আরও কাছে।
প্রতিবছরই ফ্যাশনের পালে হাওয়া লাগায় নতুন কোনো ট্রেন্ড। এখন দেখার বিষয়, গত বছরের ট্রেন্ড নতুন বছরে এসে টিকে থাকে কি না।