অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণের বিয়ের শাড়িকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার নতুন করে আলোচনায় জামদানি। জানা গেছে, শাড়িটি তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় এক বছর। আর শাড়িটার সঠিক মূল্য যদিও এখনো প্রকাশ করা হয়নি, তবে নেটিজেনদের ধারণা, এটি যে কাউন্টের সুতায় তৈরি হয়েছে, তাতে এর দাম লাখ টাকার নিচে হবে না। এই সূত্রেই অনেক নেটিজেনের মনে প্রশ্ন, জামদানি তৈরি করতে এত সময় কেন লাগে আর দামই–বা কেন এত বেশি?
আসলেই তো জামদানির দাম লাখ টাকা! যেখানে এক ভরি সোনার দাম ১ লাখ ৭৭৭ টাকা। কী আছে এই জামদানিতে যে এত দাম, জানতে চাইলে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের স্বত্বাধিকারী মনিরা ইমদাদ বললেন, সাধারণত একটি ভালো মানের সূক্ষ্ম কাজের জামদানি বুনতে তাঁতিদের তিন থেকে চার মাস লাগে। এ জন্য প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টার মতো সময় দিতে হয় তাঁদের। একটি ভালো মানের সূক্ষ্ম কাজের জামদানিতে অনেক বেশি কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়। যে কারণে দামটাও বেশি পড়ে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি তাঁতিদের নিজ হাতে করতে হয়। কারণ, মেশিনে বোনা জামদানি শাড়ির সেই ফিনিশিং বা মসৃণতা আসে না।
সাধারণত দুজন তাঁতি একটি জামদানি বুনে থাকেন। তারপর দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ খরচসহ যাবতীয় খরচ মিলিয়ে একটা ভালো মানের জামদানি তৈরি করতে লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
দেশীয় কোনো অনুষ্ঠান হোক কিংবা আন্তর্জাতিক—বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন পোশাকের কথা ভাবতে গেলে সবার আগে জামদানির কথাই মনে পড়ে। সেই জামদানি একটু বিশেষ কিছু হবে, সেটাই স্বাভাবিক। জামদানি নিয়ে কাজ করছেন, এমন কিছু দেশীয় ডিজাইনাররা তো তেমনটাই বললেন।
‘আমরা যে জামদানি তৈরি করি, এর সুতাটা মূলত ভারত থেকে আনা হয়। তবে বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে অনেক জায়গাতেই ভালো মানের জামদানির সুতা তৈরি হচ্ছে। সেই সুতাও আমরা ব্যবহার করি। এই সুতা থেকে জামদানির তৈরির প্রতিটি ধাপই বেশ কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। এ ছাড়া প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার করার কারণে জামদানির দাম একটু বেশি হয়ে থাকে,’ বলছিলেন ‘অরণ্য’–এর ক্রিয়েটিভ ডিজাইন হেড নওশিন খায়ের। জানা গেল, প্রাকৃতিক রঙের তৈরির প্রক্রিয়াটিও বেশ ব্যয়বহুল। যে কারণে অরণ্যের জামদানির দাম ১ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড়বিষয়ক ওয়েবসাইট বাংলাদেশ ফ্যাশন আর্কাইভ থেকে জানা যায়, সাধারণত জামদানি শাড়ি তৈরিতে রেশম ও সুতি সুতা ব্যবহার করা হয়। এই সুতা সাদা রঙের হয়ে থাকে। সুতা প্রয়োজন বুঝে রং করা হয়। এরপর এই সুতা ধুয়ে মাড় দেওয়া হয়। মাড় দেওয়া সুতা নাটাইয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এবার জামদানি শাড়ির তৈরির জন্য প্রস্তুত হয় সুতা। শাড়ি তৈরির বিভিন্ন ধাপেও মাড়ের ব্যবহার করা হয়। নকশা তোলার জন্য ছোট গুটিতে প্যাঁচানো হয় সুতা। ভরনার সুতা মৈারা গুটি এবং টানার সুতা বড় গুটিতে (নলি) প্যাঁচানো হয়। এই হলো জামদানি শাড়ি তৈরির শুরুর প্রক্রিয়া।
মনিরা ইমদাদ বলছিলেন, একবার ভেবে দেখুন, দুজন তাঁতি যখন একসঙ্গে একটি জামদানি বোনেন আর তার সময় লাগে তিন থেকে চার মাস, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই টাকাটা দুজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। শাড়ি তৈরির পর কখনো তা মহাজনের হাত ঘুরে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোতে পৌঁছায়, আবার কখনো দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোই সরাসরি তাঁতিদের কাজে বিনিয়োগ করে। এরপর দোকানভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ, কর্মচারীর বেতন—সব মিলিয়ে নির্ধারিত হয় জামদানির দাম।
জামদানি নিয়ে কাজ করছেন, এমন সব প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তারা মনে করেন, জামদানি শুধু ছয় গজের একটি শাড়িই তো না, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস। হাতে বোনা জামদানির তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও বেশ জটিল। মনিরা ইমদাদ ও নওশীন খায়ের দুজনই দীর্ঘদিন জামদানি নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, সঠিক দাম না পাওয়ায় অনেক তাঁতির বংশধরেরা এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এই তাঁতিদের মাথায় জামদানির অদ্ভুত সুন্দর সব নকশা আছে। শাড়ির জমিনে এই নকশা যত সূক্ষ্ম হবে, ততই দাম বাড়বে। যে কারণে ভালো মানের একটি জামদানির দাম একটু বেশিই পড়ে যায় বলে জানালেন তাঁরা।