আন্তর্জাতিক চলতি ধারা ও রঙের ধারা অনুসরণ করে জামদানিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যেতে পারে
আন্তর্জাতিক চলতি ধারা ও রঙের ধারা অনুসরণ করে জামদানিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যেতে পারে

যেভাবে জামদানি ছড়িয়ে পড়বে দেশে–বিদেশে

জামদানি শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্ব। পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জামদানির উপকরণ দিয়ে অন্যান্য পোশাক ও পণ্যও তৈরি হচ্ছে।

জামদানি সাধারণ বা আটপৌরে কোনো শাড়ি নয়। এ কারণে নিয়মিত সেটা বিক্রি হয় না, হবেও না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামদানির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে কাপড়টির বৈচিত্র্যায়ণ ঘটানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জন্য জামদানি কাপড় দিয়েই তৈরি করতে হবে নতুন নতুন পণ্য। সেই আশির দশকে যে কাজ সচেতনভাবে হোক বা অবচেতনেই হোক, করেছিলেন ডিজাইনার নিলুফার জাহান। জামদানি দিয়ে পাঞ্জাবি তৈরি করে তিনিই প্রথম বাজারজাত করেছিলেন। সে সময় মালিবাগের চম্পক নামের একটি ব্র্যান্ড বিক্রি করত এই পাঞ্জাবি। এত দিন পর এসেও কিছু পাঞ্জাবি, টপস, স্টোল ছাড়া সেভাবে আমরা ভাবতে পারিনি।

জামদানি কাপড়ের পাতলা জ্যাকেট

সময়োপযোগী পণ্য না বানালে, নতুন নতুন ভাবনায় জামদানিকে না নিয়ে এলে, শুধু শাড়ি হিসেবে জামদানিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যায়ণ ঐতিহ্যকেই সম্মান প্রদর্শন, নতুন বাজারে এর আবেদনকে আরও বিস্তৃত পরিসরে উপস্থাপন। জামদানির ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য।

জামদানি কাপড় দিয়েই বানানো যায় পাশ্চাত্য কাটের পোশাক

আর সবচেয়ে বড় কথা, উদ্ভবকালে জামদানি কিন্তু শাড়ি ছিল না। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫–১৬২৭) পারস্য থেকে নিয়ে আসা বয়নশিল্পীদের তত্ত্বাবধানে এখানকার বয়নশিল্পীরা জামদানি নামে মসলিনের সর্বশেষ যে ধরনটির উদ্ভব ঘটান, সেটি কিন্তু ছিল গজ কাপড় বা থান কাপড়। তখন যাঁরা এটা পরতেন, সেই নবাব, রাজরাজরা ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের পোশাক শাড়ি ছিল না।

২০১৬ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে জামদানি

তবে বিশ্বের নানা জাদুঘরে সংরক্ষিত শাড়ি থেকে আন্দাজ করতে সমস্যা হয় না, মসলিন বিলুপ্তির সময় থান কাপড়ের পাশাপাশি শাড়ি হিসেবেও আদৃত ছিল জামদানি। সময়ের পরিক্রমায় জামদানি মূলত শাড়ি হিসেবেই বোনা হতে থাকে। একসময় শাড়িরই সমশব্দ হয়ে ওঠে জামদানি। তাই জামদানির বৈচিত্র্যায়ণ আসলে এক হিসেবে মূলেই ফিরে যাওয়া।

মৌলিকতা অটুট রেখে নকশায় আধুনিকায়ন

নতুন নকশা বলতে কিন্তু জামদানির মূল মোটিফগুলোকে উপেক্ষা করা না। লে–আউটের পরিবর্তন এনেই রূপবদল সম্ভব। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চলতি ধারা ও রঙের ধারা অনুসরণ করে জামদানিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যেতে পারে। এ জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে গজ কাপড় তৈরি। শাড়ি কেটে অন্য পোশাক বা পণ্য তৈরি বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ, শাড়ি একটি পূর্ণাঙ্গ পোশাক।

নাগরার ওপর রিসাইকেল করা জামদানি কাপড়

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হেরিটেজ টেক্সটাইলের পুনরুজ্জীবন, বিচিত্রকরণ ও আধুনিকায়নে ডিজাইনাররা কাজ করেন। কাপড়ের মৌলিকতা অক্ষুণ্ন রেখেই নতুন পণ্য উদ্ভাবন করেন তাঁরা। বয়নশিল্পীদের শ্রদ্ধা করেন বলেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখছেন, কিন্তু নিয়ে আসছেন নতুনত্ব। আমাদের দেশে হচ্ছে ঠিক উল্টো। এখানে ডিজাইনাররা জামদানিকে নিরীক্ষার ক্যানভাসে পরিণত করে এর মৌলিকত্ব নষ্ট করছেন।

ক্যাজুয়াল পরিবেশে মানিয়ে যাবে এই জামদানি টপ

ডিজাইনারদের অন্তর্ভুক্তি

আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও ডিজাইনারদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন ও বাজারজাত করার উদ্যোগ হতে পারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কারণ, ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্টই হবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের হাতের পাঁচ। সেই লক্ষ্যে বিজিএমইএ প্রকল্প নিলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ফলপ্রসূ হয়নি।

টেকসই ও নৈতিক উৎপাদন

চশমাটাও নাহয় থাকল জামদানির খাপে

জামদানি বয়নে প্রকৃতিবান্ধব উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার অনেকাংশে ফিরে এসেছে। এই বৃদ্ধির পাশাপাশি এজো ফ্রি রং ব্যবহারে বয়নশিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। মসলিনের মতো জামদানিও একটা সময় পর্যন্ত কেবল হাতে কাটা, সুতি সুতায় বোনা হতো। ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ (১৮৭১-১৯১৫) প্রথম সিল্ক সুতা ব্যবহার করে হাফ সিল্ক জামদানির প্রচলন করেন। হাতে কাটা সুতায় জামদানি বোনার রেওয়াজ আমাদের বয়নশিল্পীরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। সেটাও পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

গল্পকথনে গুরুত্বারোপ

জামদানি শাড়িতে জমকালো সাজ

জামদানির অনবদ্য ইতিহাসকে জানানোর সঙ্গে কারিগরদের গল্প, ঐতিহ্যবাহী বয়নকৌশল, বস্ত্রবয়নের নেপথ্য কলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব সম্পর্কে দেশি ও বিদেশি ভোক্তাদের অবহিত করা প্রয়োজন। দৃশ্যত আকর্ষণীয় লেবেল বা ট্যাগ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ভিডিও, ছবি শেয়ার করা গেলে সহজেই অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে।

ভৌগোলিক নির্দেশকের সুবিধা

জামদানি কাপড়ের তৈরি গয়না

২০১৬ সালে জামদানির ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেলেও আজও সঠিকভাবে সেটি কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ আরমিসের মতো বিখ্যাত ব্র্যান্ড ভারতের জ্যাকার্ডে বোনা স্টোলকে জামদানি বলে বিক্রি করছে। আমরা এই সুবিধা নিতে পারছি না ‘বয়ন কূটনীতি’র দুর্বলতা ও নতজানু মনোভাবের কারণে। এই পরিস্থিতি বদলেরও সময় এসেছে।

পোশাকের বাইরে

জামদানি দিয়ে বানাতে হবে সময়োপযোগী পণ্য

অন্দর সাজানোর নানা অনুষঙ্গ, যেমন কুশন, ওয়াল হ্যাংগিং, ব্যাগ, পর্দা, টেবিল রানার এমনকি প্রযুক্তি আনুষঙ্গিকের মতো পণ্যে জামদানিকে সংযুক্ত করে বৈচিত্র্যময় করা যেতে পারে। এসব উদ্যোগ গ্রাহকের পরিসর উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এ জন্য উল্লিখিত পদক্ষেপ গ্রহণকে সুনিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। ঐতিহ্যবাহী এই বয়নশিল্পের অস্তিত্ব সমুন্নত থাকবে। বিশ্বব্যাপী সমাদৃতও হবে। উপরন্তু এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত বয়ন ও কারুশিল্পী সম্প্রদায়ের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করবে। দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে এই ঐতিহ্যবাহী বয়নশিল্প।