কালির আঁচড়ে পিঠের নিচ থেকে ওপরে বেয়ে বেয়ে উঠছে কলি থেকে আস্ত ফুল। কারও কাছে এটি কেবলই ফুলের জলসা, আবার কারও কাছে নারীর বেড়ে ওঠার, প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রতীক। এখানে শরীর যেন আস্ত ক্যানভাস। যেখানে থাকে প্রিয় উক্তি, বাক্য, পছন্দের পঙ্ক্তি কিংবা ছবি, যা কেবল ফ্যাশন স্টেটমেন্টই নয়, বরং সেখানে ফুটে ওঠে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব, নিজস্বতা ও ভিন্নতা। ব্যক্তিভেদে এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিই শিল্পের জন্ম দেয়, শিল্পকে পরিপূর্ণ করে। বলছি ট্যাটু কিংবা উল্কির কথা।
তবে ট্যাটুর ইতিহাস অন্তত ৬০ হাজার বছরের পুরোনো। ৩৩৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে কার্বনের কালিতে ডট দিয়ে আঁকা হতো। মিসরের পিরামিডের চার হাজার বছরের পুরোনো মমিগুলোর শুষ্ক ত্বকে আঁকা উজ্জ্বল ট্যাটুগুলোই সবচেয়ে প্রাচীন বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা। বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে ট্যাটু চালু ছিল, আছে। পাশ্চাত্যে ট্যাটু জনপ্রিয়তা পায় প্রচলিত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে গিয়ে, প্রতিবাদরূপে। সেখানে ট্যাটুতে এমন সব কথা বা প্রতীক আঁকা হয়, যা প্রতিষ্ঠিত সিস্টেম, প্রথা বা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
আমাদের দেশে ট্যাটু সাধারণত নিছক ফ্যাশন হিসেবেই গ্রহণ করা হয়। তবে অনেকে মনে করেন, ট্যাটু পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবের ফল। সেটা অবশ্য পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে কয়েক শতাব্দী ধরে ট্যাটু-সংস্কৃতির ধারা চলে আসছে। তখনো বিশ্বায়ন, সংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রভৃতি বিষয়গুলো ঘটেনি। তবে বিশ্বায়নের ফলে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রাম জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর ট্যাটু হঠাৎ করেই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে এই ট্যাটুর ট্রেন্ড বাড়ছে ঝড়ের গতিতে। ইনস্টাগ্রাম, গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের খ্যাতনামা শিল্পী, অভিনেতা, ক্রিকেটার, নায়কদের অনুকরণ, ট্যাটু স্টুডিওর প্রসার, সহজলভ্যতা—সবকিছু মিলিয়ে তরুণ-তরুণীদের এই শিল্পের প্রতি ঝোঁক বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারে রয়েছে কর্মকার ট্যাটু জোন। এই শিল্পের বিকাশ নিয়ে এর কর্ণধার বিপ্লব কর্মকার বলেন, ‘অতীতে এই শিল্প সম্পর্কে মানুষ এতটা অবগত ছিল না। পাশাপাশি ধর্মীয় ভীতি, ট্যাটুর ঝুঁকি নিয়ে ভীতি কিংবা সুচের ভয় ও ট্যাটু নিয়ে নানান ট্যাবুর কারণে মানুষ এই বিষয়ে কিছুটা অনাগ্রহী ছিল। কিন্তু ট্যাটু জনপ্রিয় হওয়ার পর তারা ট্যাটুর বিষয়ে সাহসী হয়েছে। আস্থাভাজন স্টুডিওর সংখ্যা বেড়েছে। আর শরীরে ট্যাটু এঁকে তারা শখ পূরণ করছে।’
তবে অনেক চর্মরোগ–বিশেষজ্ঞরা ট্যাটুর ঝুঁকি নিয়েও কথা বলেছেন। যেমন যাদের এলার্জি, ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে, তাদের ট্যাটুর ব্যাপারে অধিক সতর্ক হতে হবে।
লাল, সবুজ, হলুদ এবং নীল কালিতে ত্বকে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ট্যাটুর আশপাশে ফুসকুড়ি হতে পারে।
যদি ট্যাটু আঁকার ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো সংক্রমিত রক্তে দূষিত হয়, তাহলে আপনিও বিভিন্ন রক্তবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং হেপাটাইটিস ‘সি’সহ রয়েছে এমআরআই জটিলতা।
ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) পরীক্ষার সময় ট্যাটু বা স্থায়ী মেকআপের কারণে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ এলাকায় ফোলাভাব বা জ্বালা হতে পারে।
কিছু ক্ষেত্রে, ট্যাটু ও এমআরআই চিত্রের নিম্ন গুণমানের কারণে দেখা দিতে পারে নতুন নতুন জটিলতা।
তবে কিছু বিষয়ে সতর্কতা কমাতে পারে জটিলতা :
* ট্যাটু আর্টিস্টের হ্যান্ডগ্লাভস পরিধান করে ট্যাটু আর্ট করা, একই সুচ দ্বিতীয়বার ব্যবহার না করা, উন্নত মানের কালি ব্যবহার করা।
* স্কিন টোন, বয়স, স্কিন সেনসেটিভিটি যাচাই করে ট্যাটু আঁকা। এ ক্ষেত্রে ঊরু, হাত, কাঁধ, বাইসেপ, পিঠ ট্যাটু আর্টের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ ও ব্যথা কম পাওয়া যায়।
* ট্যাটু আঁকার প্রথম এক মাস কিছু নিয়ম মেনে চলা। যেমন পানি ও সূর্যের সরাসরি আলো কম লাগানো, ট্যাটু অঙ্কিত স্থানে নখ, সাবান না লাগানো, সুইমিং পুল, সমুদ্রের পানি এড়িয়ে চলা, নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা, অঙ্কিত স্থান জামাকাপড়ে আঁটসাঁট করে সব সময় ঢেকে না রাখা, অ্যালার্জি হয় এমন খাবার, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা ইত্যাদি।