প্রদর্শনীর পরিসর ছোট হলেও শিক্ষণীয়
প্রদর্শনীর পরিসর ছোট হলেও শিক্ষণীয়

সংক্ষিপ্ত পরিসরের শিক্ষণীয় উপস্থাপনা

শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাঙালি প্রস্তুত হচ্ছে নতুন বছরের আবাহনে। বিষণ্নতার মধ্যেও আনন্দের আহ্বান শোনার প্রতীক্ষায় কান পেতে আছে। কারণ, বাঙালির সঙ্গে আর যা–ই হোক বিষাদ ঠিক মানায় না। বাঙালির জীবনে ভরপুর বৈচিত্র্য। তার ভাবনা, যাপন আর সংস্কৃতি বর্ণময়। উৎসবগুলোতে বহিঃপ্রকাশ ঘটে সেই বর্ণময়তার; তা সে ধর্মীয় হোক বা সামাজিক। নতুন বছরের উদযাপনেও ঝরে অবিকল উচ্ছ্বাস। এভাবেই বাঙালি বয়ে চলেছে তার আবহমানকালের ঐতিহ্য।

নববর্ষের সঙ্গে যোগ শাড়ির

পয়লা বৈশাখ বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। এই নববর্ষের সঙ্গে বাঙালিয়ানার যেমন যোগ, তেমনি সংযোগ বাঙালি নারীর চিরায়ত ভূষণ তাঁতের শাড়ির; যা আজ একপ্রকার বিলুপ্তির পথেই। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে, বৈশাখ সংগ্রহে শাড়ির সম্ভার সাজিয়ে বিক্রিকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং চমৎকার একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে নবীন লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড কিউরিয়াস।

‘অলংকৃত তাঁতের শাড়ি প্রদর্শনী’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীর পরিসর সংক্ষিপ্ত হলেও যথেষ্ট শিক্ষণীয়। নগরীর অভিজাত এলাকার একটি আউটলেটে এ ধরনের আয়োজন নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তা ছাড়া এই প্রদর্শনীর কিউরেশন শাড়িপ্রিয় বাঙালিকে কিছুটা হলেও জোগাবে ভাবনার খোরাক।

এই প্রদর্শনী জোগাবে ভাবনার খোরাক

কিউরিয়াসের বনানী আউটলেটের চতুর্থতলার ফ্লোর সাজানো হয়েছে নানা অনুষঙ্গে। এলিভেটারে চেপে সেখানে পৌঁছে এই আয়োজনের কিউরেটর তথা কিউরিয়াসের ডিজাইন কনসালট্যান্ট চন্দ্র শেখর সাহার সঙ্গে চটজলদি ঘুরে দেখা গেল এই প্রদর্শনী।১ এপ্রিল শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী চলবে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত।

পুরো আবহে বাংলাদেশের হস্তশিল্পের উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায়। আমাদের দেশের পরম্পরার শিল্পীদের সৃজন ঐশ্বর্য পুনরায় দেখার অবকাশ মেলে। শুরুতেই রয়েছে একটি ফটোবুথ। সেটা সাজানো হয়েছে বাঁশের নানা নকশায় বোনা জাফরি দিয়ে। এর ওপর সাজানো হয়েছে হাতপাখা।

বাঁশের জাফরি ও হাতপাখায় সাজানো হয়েছে ফটোবুধ

নানা আকার, বুনন আর নকশার। সব কটিই গোল। এগুলোও বাঁশের তৈরি। নকশা-ভিন্নতায় প্রতিটি দৃষ্টিনন্দন। এখানেও আমাদের সমাজজীবনের প্রতিফলন স্পষ্ট হয়। স্পষ্ট হয় আমাদের কারুশিল্পীদের নৈপুণ্য। উভয় অনুষঙ্গে বয়নের বিষয়টি মানিয়ে যায় প্রদর্শনীর মূল ভাবনার সঙ্গে।

নববর্ষ, বাঙালিয়ানা, শাড়ি—ত্রয়ীর সম্পর্ক নিবিড়। এ জন্য প্রদর্শনীতে শাড়ি ছাড়াও অন্য অনেক কিছুকে স্থান দেওয়া হয়েছে। রয়েছে শাড়ির তৈরির সব অনুষঙ্গ এবং অলংকরণ ভাবনা, উপকরণ ও পদ্ধতি। এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুটি ইনস্টলেশন।

প্রথমে দৃষ্টি কাড়ে তাঁত

প্রথমে দৃষ্টি কাড়ে তাঁত। সেখানে দেখা যায় বয়নশিল্পীকে তাঁত বুনতে। এটাতে আর্টিজান অ্যাট ওয়ার্কেরই আদল মেলে। তাঁদের সামনে রাখা তিনটি ঝুড়িতে তুলা আর বিভিন্ন কাউন্টের সুতা। তাঁতের ঠিক পেছনে স্বচ্ছ কাপড়ে সাদা অক্ষরে মুদ্রিত ২০১৮ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যা বুরোর তাঁত জরিপের নানা পরিসংখ্যান ও তথ্য। বাংলাদেশের বিভাগওয়ারি তাঁতের সংখ্যাও রয়েছে।

একটু এগোলে দেখা যাবে বয়ন শুরুর আগের নানা পর্যায়। এখানে রয়েছে লাইভ এবং ছবি। সুতার লেছি তৈরিটা আর্টিজান অ্যাট ওয়ার্ক। আর ছবিতে সুতা, টানা, সানা এসব বিভিন্ন পর্যায় ধরা হয়েছে স্থিরচিত্রে।

এই অংশে রয়েছে বয়নপূর্ব প্রক্রিয়া

দুটি অংশই অনুষঙ্গের উপস্থিতি ব্যঞ্জনা তৈরি করে। পুরো বিষয়টি শিক্ষণীয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় দর্শক তথা ক্রেতাকে ভাবায়, সেটা হলো এই শিল্পের প্রতি তাঁর বোধ, আর একে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব। কারণ, একটি শাড়ি কেনা মানে পরোক্ষে এই শিল্পকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করা, বাংলাদেশের অসামান্য মেধাবী বয়নশিল্পীদের পাশে দাঁড়ানো।

কারণ, পরিস্থিতির ভয়াবহতা ফুটে ওঠে ইনস্টলেশনে। ওপরের একটি স্থিরচিত্রে দেখা যায় জ্যাকার্ড তাঁতে শাড়ি বয়নরত বয়নশিল্পী। নিচে ছড়ানো পাঞ্চকার্ড। জ্যাকার্ড ও ডবির নকশার তোলা এই কার্ড ব্যবহার করা হয়। পুরোনো পাঞ্চকার্ডকে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। তাতে যেন ভবিষ্যতের দুঃসহ দিনেরই আভাস মেলে।

পুরোনো পাঞ্চকার্ডকে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে

পরিস্থিতি তো সেদিকে যাচ্ছে। বিলুপ্তির পথে আছে আমাদের ঐতিহ্যের বয়নশিল্প। একদিকে পৃষ্ঠপোষণার অভাব, অন্যদিকে যন্ত্রচালিত তাঁতের আগ্রাসন। এর ওপর আবার বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়েছে কাঁচামালের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধি।

এখানে আরও আছে রিড বা সানা। যেটা বাঁশের তৈরি। এত সূক্ষ্ম, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এটা আমাদের বাঁশশিল্পের অনবদ্য নিদর্শন। কে জানে, এটাও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে।

এখানে আছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দুটি পুরোনো কাঁথা

এখানেই ঝোলানো রয়েছে দুটি পুরোনো কাঁথা। বিশেষ বৈশিষ্ট্যের। কাঁথাগুলো অনেক পুরোনো। বহু ব্যবহৃত। একদিকে সারি সারি পাড় বসানো, অন্যদিকে জমিন। এভাবেই পুরোনো তাঁতের কাপড় দিয়ে কাঁথা তৈরি করতেন তাঁতিবাড়ির বউ-ঝিরা। এসবও আজ জাদুঘরের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে।

এবারের থিমে অন্য সব বিষয়কে ছাপিয়ে নতুনত্বের দাবি রাখে সবজির ফুল। এই তালিকায় আছে করলা, মিষ্টিকুমড়া, বেগুন, শিম আর পটোল। প্রতিটি ফুলই দৃষ্টিনন্দন। আকার আর রঙে অনন্য। নগরবাসীর পক্ষে এসব ফুল দেখার সুযোগ হয় না। ফলে ছবিতেও হলেও প্রত্যক্ষ করা যাবে। একই সঙ্গে দেখা যাবে এই ফুলগুলো কীভাবে নকশা উপাদান হয়ে ওঠে এবং তা শাড়ির জমিনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে।

থিম হিসাবে নতুনত্বের দাবি রাখে সবজির ফুল

সবজির ফুলকে থিম হিসেবে বেছে নেওয়ার কাজটি করেছেন কিউরিয়াসের চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন কিরণ। তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পৃক্তি। তিনি জানেন বাংলাদেশে তৈরি হয় বিশ্বমানের পণ্য। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি কিউরিয়াসের প্রতিটি পণ্যকে সেই মান দিতে বদ্ধপরিকর। তাঁর লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে ক্রেতারা তাঁর ব্র্যান্ডের যে পণ্যই কিনুন, সেটা হবে আন্তর্জাতিক মানের।

প্রদর্শনীতে বিভিন্ন কর্নারে রাখা হয়েছে প্রতিটি থিমের পণ্য। সেগুলো ঘুরে দেখতে মন্দ লাগে না। তবে দৃষ্টি কাড়ে, নস্টালজিক করে আরেকটির ইনস্টলেশন। সেখানে রাখা কয়েকটি বোঁচকা। পাশে লাল সালুতে মোড়া খাতা। আগের দিনে এভাবেই বোঁচকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি শাড়ি ফেরি করতেন শাড়িওয়ালা। বাকিতেও শাড়ি বিক্রি করা হতো। আর সে হিসাব লিখে রাখা হতো খাতায়। এই অংশটি কোনো সন্দেহ নেই, স্মৃতিমেদুর করবে জ্যেষ্ঠ দর্শকদের।

এই অংশটি স্মৃতিমেদুর করবে

রাজবাড়ির আবহ তৈরি করতে ছবির নিচে বাঁশ দিয়ে তৈরির স্ট্যান্ডে রাখা আছে রুপার টিপট ও কাপ। একইভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ছবি নিচে রাখা আছে ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের কাছ থেকে আনা প্রাচীন স্থাপনার ইট, নকশাদার টেরাকোটা; আর সবজির ফুলের নিচে রয়েছে তাজা সবজি।

প্রদর্শনীতে চাঁদোয়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে স্বচ্ছ কাপড়ে মুদ্রিত বাংলাদেশের বিভিন্ন বয়ন এলাকার নাম। তথ্য তাঁত বোর্ডের কাছ থেকে নেওয়া। তবে এসব জায়গায় সব কটিতেই এখন আর তাঁত নেই। ফলে প্রদর্শনী যেমন ভালো লাগায়, তেমনি অজানা আশঙ্কায় মন ভারও করে। তবে এটা অবশ্যই ক্রেতাদের জন্য শিক্ষণীয় হবে। বিশেষত নবীন প্রজন্মের জন্য। বাচ্চারাও জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। তারা বাংলাদেশকে জানতে পারবে এই সৃজন-জগতের মধ্য দিয়ে।

প্রদর্শনীতে চাঁদোয়া হিসেবে ব্যবহৃত কাপড়ে মুদ্রিত বাংলাদেশের বয়ন এলাকার নাম

প্রদর্শনীর কিউরেটর চন্দ্র শেখর সাহা এর আগে বহু প্রদর্শনী কিউরেট করেছেন। প্রতিটিতে স্পষ্ট থাকে তাঁর ভাবনাবৈচিত্র্য। ফলে প্রদর্শনীগুলো হয়ে ওঠে অনন্য বৈশিষ্ট্যে ঋদ্ধ। ছোট হলেও এই প্রদর্শনীতে প্রতীয়মান তাঁর ভাবনার প্রতিফলন।
এরই অংশ হিসেবে নিচতলায় স্থায়ী প্রদর্শনী অংশে সাজানো হয়েছে বৈশাখ উপলক্ষে তৈরি নকশিকাঁথার নানা ধরনের সেলাইয়ের প্রেরণায় তৈরি গয়না আর হাতপাখায়।

নকশিকাঁথাপ্রাণিত গয়না

বাঙালিয়ানার বোধকে পোশাক-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সমসাময়িক সৃজনশীলতা আর আধুনিক উপস্থাপনায় ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে প্রয়াসী কিউরিয়াস। এই অভিযাত্রায় প্রয়োজন ভোক্তা তথা পৃষ্ঠপোষকদেরও সম্পৃক্ততা। যূথবদ্ধ প্রচেষ্টাতেই সম্ভব বাংলাদেশের ঐতিহ্যের বয়নশিল্পকে টিকিয়ে রাখা।