লেডি ইন রেড
লেডি ইন রেড

লাল কাপড় পরিধান দিবস

লাল রঙে রাঙিয়ে

হার্টের অসুখে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে মৃত্যুবরণ করে লাখ লাখ মানুষ। ফলে এ রোগের জন্য সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম শুক্রবার লাল পোশাক দিবস পালন করা হয়। বছরে একটি দিন লাল পোশাক পরে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও রক্ত বিষয়ে সচেতন হতে দিনটি পালনের সূচনা করে আমেরিকার জাতীয় হার্ট, লাং অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউট। ওয়্যারিং রেড ডে বা লাল পোশাক পরিধান দিবস তাই শুধু একটি ফ্যাশন ইভেন্টই নয়। এটি আমাদের সুস্বাস্থ্য ও জীবনের সঙ্গে জড়িত। দিনটি আমাদের স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল মেনে চলার ব্যাপারে সচেতন করে।

লাল রঙের মতো এত রকম অনুভূতি জাগানোর ক্ষমতা মনে হয় কোনো রঙেই নেই। লাল বিপদ সংকেত, বিয়ের লাল বেনারসি, চাইনিজ নববর্ষের শুরুতে উৎসবের সাজে সেজে ওঠা লালে লাল চীনদেশ আর আমাদের প্রিয় পতাকার মধ্যে টকটকে লাল সূর্য। প্রতিটি লোহিত বর্ণ তার আবেগ আর তাৎপর্যের দিক থেকে অনেকটাই আলাদা। পরনের পোশাকে লাল রঙের ব্যবহার নিয়ে ঘেঁটে দেখলে পাওয়া যায় লাল কাপড়ের বৈচিত্র্যময় সব গল্প।

লাল রঙের মতো এত রকম অনুভূতি জাগানোর ক্ষমতা মনে হয় কোনো রঙেই নেই

কাপড় রাঙাতে যখন প্রাকৃতিক রংই একমাত্র অবলম্বন ছিল, তখন একেবারে টকটকে এই আকাঙ্ক্ষিত লাল রং খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর ছিল। আদিকাল হতেই তুর্কিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও আমাদের উপমহাদেশে ম্যাডার বা রুবিয়া গাছের শিকড় শুকিয়ে তা দিয়ে কাপড়ে লাল রং করা হতো। অতি প্রাচীন তুর্কি গালিচায়ও এই রং ব্যবহার করার নজির পাওয়া গেছে। তবে ওই লাল রং অনেকটা ইট লাল বা মরচে লাল রং।

খনিজ পদার্থ সিনাবার চূর্ণ করে পাওয়া টকটকে লাল সিঁদুরের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ জানলেও এতে সিসাজনিত বিষক্রিয়া হতে পারে বলে কাপড় রাঙাতে তা ব্যবহার করা হতো না। চীনদেশেও সেই বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ উৎস থেকেই লাল রং আহরণ করে কাপড় রাঙানো হতো, তেমনটাই জানা যায়। কিন্তু একচেটিয়াভাবে কাপড় রাঙানোর টকটকে লাল রঙের আধিপত্য ধরে রেখেছিল আদিবাসী আমেরিকান ও মেক্সিকানরা। তারা কোচিনিল নামের এক অদ্ভুতুড়ে পোকা থেকে এই রক্তলাল রং সংগ্রহ করত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৫০০ শতাব্দীতে যখন স্প্যানিশরা এই রঙের সন্ধান পেল ও ইউরোপীয় দেশগুলোয় রপ্তানি করতে শুরু করল, তখনো তারা জানত না যে এগুলো কী। কারণ পোকাগুলোকে শুকিয়ে যখন বস্তাবন্দী করা হতো, তখন কারও বোঝার উপায় ছিল না যে এগুলো কোনো গাছের বীজ, নাকি খনিজ পদার্থ নাকি পোকা।

লেডি ইন রেড

লাল রঙের এই দুষ্প্রাপ্যতাই অতীতে লাল কাপড়কে চরম আভিজাত্যপূর্ণ ও উচ্চশ্রেণির মানুষের পরিধেয় রঙের মর্যাদা দিয়েছিল। ফ্রান্সে তো রীতিমতো নিষেধই ছিল সাধারণ জনগণের জন্য লাল পোশাক পরা। এমন নিষেধাজ্ঞা প্রাচীন জাপানেও ছিল বটে, কিন্তু লুকিয়ে জামার লাইনিং বা অন্তর্বাসে লাল রঙের কাপড় ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে সেখানে। তারপর যখন ১৮৬৫ সালের দিকে বাণিজ্যিকভাবে কৃত্রিম রং তৈরি ও ব্যবহার করা শুরু হয়ে গেল বস্ত্রশিল্পে, তখন দৃশ্যাবলি পালটে গেল। তবু এখনো প্রাকৃতিকভাবে রুবিয়া গাছ বা কোচিনিল পোকার লাল রঙে রাঙানো কাপড়ের রয়েছে আলাদা কদর।

লাল রঙের কাপড়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানামুখী অভিব্যক্তি ও বৈচিত্র্যময় সব তাৎপর্য। লাল মানেই ভালোবাসার রং। লাল বেনারসি পরা নববধূর অবয়ব এতটাই প্রতীকী যে যতই বিয়েতে অন্য রং পরার প্রচলন হোক না কেন, কনে বলতেই মনের পটে ভেসে ওঠে সেই লাল রং। অন্যান্য অনেক দেশ যেমন চায়নাতেও বিয়েতে কনের পোশাক হয় টুকটুকে লাল। জাপানেও লাল কিমোনো পরেন অনেক বিয়ের কনে।

আমাদের বিয়েবাড়ি মানেই লাল রং

আমাদের উপমহাদেশে শুধু কনে নয়, বিয়েবাড়ি মানেই লাল রং! লাল রং ভালোবাসার প্রতীক সারা দুনিয়াতেই। তাই তো ইংরেজিতে যেমন আছে বিখ্যাত গান ‘লেডি ইন রেড’, বাংলায় ‘লাল টুকটুকে বউ যায়রে লাল নটের খেতে’ গানটি মুখে মুখে ফেরে।
শুধু নর–নারীর ভালোবাসা নয়, লাল রং আমাদের কাছে পতাকার লাল সূর্য।

দেশপ্রেমের প্রতীক এই লাল রং আমাদের লাখো শহীদের আত্মত্যাগের কথা বলে। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের সাজে লাল রং থাকতেই হয় সে কারণে। লাল রং রক্তের রং বলে ইউরোপীয় অনেক দেশে যুদ্ধসাজে লাল পোশাক পরিধান করা হতো শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসেবে।

লাল রঙের কিন্তু বিশেষ ধর্মীয় তাৎপর্যও আছে। উপমহাদেশীয় অনেক সাধু ও ধর্মগুরু লাল বর্ণের সেলাইবিহীন কাপড় পরেন। চাইনিজ নববর্ষে অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যসহকারে মূল উৎসবে লাল কাপড় পরা হয়। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের ক্যাথলিক চার্চে বিশেষ দিনে পাদরিরা লাল পোশাক পরেন।

বর্তমান সময়ে লাল রঙের পোশাক নারী-পুরুষ, ছেলে–বুড়ো সবাই পরে থাকেন ঘরে-বাইরে। যেকোনো অনুষ্ঠানে বা উৎসবে লাল রঙের পোশাক তার আমেজ আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রিয়াকে লাল শাড়িতে দেখতে ভালোবাসেন সবাই। আবার শিশুদের লাল জামায় দেখতে লাগে লাল ফুল বা প্রজাপতির মতো। ছেলেমেয়ের উপহার দেওয়া লাল পাঞ্জাবি পরে বাবার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে আমরা সুখ খুঁজে নেই। লাল পোশাক নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার আজকাল৷ দিনে বা রাতে, রোদে বা বৃষ্টিতে, ঘরে বা বাইরে সব জায়গায় সব সময় লাল।

লাল রং জীবনের প্রতীক, সেই সঙ্গে মৃত্যুরও

লাল রং জীবনের প্রতীক, সেই সঙ্গে মৃত্যুরও। তাই রেডক্রসের প্রতীকে আছে লাল। বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্স ও ডাক্তারের প্রতীক ও লেখায় লাল রং ব্যবহার করা হয়। রক্তের রং লাল আর এই রক্তের প্রবাহ, সঞ্চালন, জীবন, মৃত্যু সবকিছুর সঙ্গে হৃদ্‌যন্ত্রের যোগাযোগ খুব বেশি। হার্টের অসুখে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে মৃত্যুবরণ করে লাখ লাখ মানুষ। ফলে এ রোগের জন্য সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম শুক্রবার লাল পোশাক দিবস পালন করা হয়। বছরে একটি দিন লাল পোশাক পরে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও রক্ত বিষয়ে সচেতন হতে দিনটি পালনের সূচনা করে আমেরিকার জাতীয় হার্ট, লাং অ্যান্ড ব্লাড ইনস্টিটিউট। ওয়্যারিং রেড ডে বা লাল পোশাক পরিধান দিবস তাই শুধু একটি ফ্যাশন ইভেন্টই নয়। এটি আমাদের সুস্বাস্থ্য ও জীবনের সঙ্গে জড়িত। দিনটি আমাদের স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল মেনে চলার ব্যাপারে সচেতন করে।