ভাবছিলাম কী হতে পারত।
একই দিনে নববর্ষ আর প্রথম রোজা। তাই মানুষের উৎসবমুখর থাকার কথা ছিল দিনভর। সকালে রূপসদনগুলোয় প্রত্যাশিত ছিল দীর্ঘ লাইন। রমনা বটমূলে উৎসাহী মানুষের উপস্থিতি আর পথেঘাটে নতুন পোশাকে সানন্দ নর-নারীর উচ্ছল উদ্যাপনের দৃশ্যই হতে পারত স্বাভাবিক।
সারা দিন বিপণিবিতানগুলোয় থাকার কথা ছিল উপচে পড়া ভিড়। আর দুপুর গড়ালে রসনাবিলাসী নগরবাসী ছুটে যেত রেস্তোরাঁগুলোয়। ইফতারির বৈচিত্র্য ঢাকায় যথেষ্ট। নানা পদ আর ডেলিকেসিও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ফলে মনমাতানো এসব ইফতারির জন্য রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় হওয়াটাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে, রাজধানীবাসী রোজার প্রথম দিন থেকেই শুরু করে ঈদ শপিং। কখনো আবার রোজা শুরুর আগে থেকেই কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। সে জন্য এমন একটা দিনে শপিং মল আর মার্কেটগুলোয় ভিড় না থাকাটাই অস্বাভাবিক ঠেকত।
অথচ হলোটা কী!
বাংলা বছরের প্রথম দিন, রোজারও প্রথম দিন। দেশের মানুষ লকডাউনে থাকল ঘরবন্দী। অনন্যোপায় না হলে কারোর বাসার বাইরে থাকার উপায় নেই। উদ্যাপন তো দূর কি বাত। তাই তো দৃষ্টিগোচর হলো না বাঙালির প্রাণের উৎসব দিনে খোঁপায় ফুল, লাল পাড় সাদা শাড়িতে কোনো তরুণী কিংবা লাল-সাদা পাঞ্জাবিতে কোনো তরুণের প্রাণময়তা। দেখা গেল না কোনো রেস্তোরাঁয় ইফতারের জন্য মানুষের উপস্থিতি; কিংবা শপিংয়ের জন্য ক্রেতার ঢল।
গত বছরও ছিল অভিন্ন পরিস্থিতি। করোনা অতিমারি এবারও সবকিছু ভেস্তে দিয়েছে। অথচ সময়টা যখন একটু একটু করে ভালোর দিকে যাচ্ছিল, আশাবাদী হয়ে উঠছিল সবাই, ব্যবসার পালে লাগছিল সুবাতাস, তখনই এল এই আচমকা ধাক্কা। দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিস্রস্ত সবাই।
তাই বলে প্রকৃতি তো আর কারও নিয়ম মেনে চলে না; তাই সে ঠিক পল-অনুপলের হিসাব মেনে হাজির করেছে বৈশাখ। গত বছর মন খারাপ ছিল সন্দেহ নেই। সেটা ছিল প্রাথমিক ধাক্কার কারণে। সেটা অনেকখানি কাটিয়েও ওঠা গিয়েছিল। কিন্তু এবারের মন খারাপের স্বরূপটা ভিন্ন। এ যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সবাই এখন সওয়ার হয়েছে অনিশ্চিতের। কবে পরিস্থিতি ঠিক হবে, তার কোনো আভাষ নেই। সামনের দিনগুলোয় কী অপেক্ষা করে আছে, তারও নেই কোনো ইঙ্গিত। অল্পতে খুশি বাঙালির মুখে কোনোভাবেই হাসি ফোটার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বাঙালির উদ্যাপনে দুটো বিষয় সব সময়ই প্রাধান্য পায়—অসন ও বসন। খাদ্য ও পোশাক। অবশ্য বাঙালির কেন, আবিশ্বের সব জাতির মধ্যেই সেটা প্রতীয়মান। পয়লা বৈশাখই হোক কিংবা ঈদ, বাঙালির কাছে পোশাক যতটা না তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে রসনার উপাচার। বৈশাখে নতুন কাপড় পরার রীতি খুব বেশি দিনের নয়; তুলনায় ঈদে চাই নতুন কাপড় চিরাচরিত। বরং বৈশাখে নানা কারুপণ্য আর মণ্ডা-মিঠাই ছিল এগিয়ে।
তবে বাঙালি এখন যেকোনো উৎসবেই নতুন পোশাক পরে। বৈশাখ তাই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য উল্লেখযোগ্য উপলক্ষ হয়। আর ঈদ তো কথাই নেই। বছরের সিংহভাগ ব্যবসা হয় ঈদে। এবার বৈশাখ আর ঈদের বিক্রি বলতে গেলে গলাগলি করেই চলছিল। ঢিলেঢালা লকডাউনের প্রথম দিনে দোকানপাট বন্ধ রাখায় হোঁচট খেল বিক্রি। পরে খুলে দেওয়া হলেও সেটা সেভাবে কেন জানি গতি পায়নি। তবু কিছুটা বিক্রি হয়েছে। সেটাও ছিল অদ্ভুত। কোনো দিন হঠাৎ একেবারেই কম তো পরের দিন কিছুটা বেশি। কোনো দিন আবার আশাতীত বেশি। এমনই জানালেন একাধিক ফ্যাশন হাউসের কর্ণধার।
আবার কেউ কেউ বললেন যে তুলনামূলকভাবে অনলাইনে বিক্রি বেড়েছে। চৈত্রের শেষ দিন পর্যন্ত অর্ডার পাওয়া পোশাক সরবরাহে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে অনেককেই।
তবে দোকানে বিক্রির একটা আলাদা ইম্প্যাক্ট আছে। একটা উৎসবের আমেজ কাজ করে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
কথা হচ্ছিল একজন বিউটিশিয়ানের সঙ্গে। তিনিও হতাশার সুরে বললেন, এবারের বৈশাখও গেল। ঈদে যে কী হবে, কত দিন এই অবরুদ্ধতা চলবে, কে জানে। তিনি আরও বললেন যে আমাদের সেবা তো অনলাইনে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সবকিছু বন্ধ রেখে সবাইকে বেতন দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হবে।
গতবারের ঘাটতি এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি ফ্যাশন কিংবা বিউটি ইন্ডাস্ট্রি। শীর্ষ সারির একটি ফ্যাশন হাউসের কর্ণধার মনে করেন, ‘গতবারের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেই অন্তত তিন বছর লেগে যাবে; সেখানে এবার আবারও ধাক্কা খেতে হলে কী যে হবে, তা ভাবতেই শিউরে উঠছি।’
গতবারের বৈশাখ আর ঈদের মধ্যে ব্যবধান ছিল মাস দেড়েকের। এবার সেটা কমেছে আরও। গতবার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোক্তারা সর্বস্ব লগ্নি করেছিলেন। এবার আর যা ছিল তাও দিয়ে প্রায় নিঃস্ব। অথচ ঋণ সহায়তাও মেলেনি। এরই মধ্যে অনেকেরই একাধিক আউটলেট বন্ধ করে দিতে হয়েছে। গত এক বছরে প্রতিটি হাউসেরই জনবল কমিয়ে ফেলতে হয়েছে। সংখ্যা নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।
এই পরিস্থিতিতে বৈশাখ আর ঈদ নিয়ে প্রস্তুতির কমতি ছিল না। বরং বোশেখের লাল-সাদার বৃত্তকে আরও বিস্তৃত করে অন্য রঙের প্রবেশ কয়েক বছর ধরেই টের পাওয়া যাচ্ছিল, এবার সেটা আরও বেড়েছে। কারণ একই পোশাক ঈদেও যাতে পরা যায় সেটা ছিল পরিকল্পনায়।
এরই মধ্যে প্রায় সব হাউসই বৈশাখ সংগ্রহের পাশাপাশি ঈদ সংগ্রহও বাজারে ছেড়েছিল। এবারও আয়োজনের ব্যাপকতার পাশাপাশি বৈচিত্র্য রয়েছে লক্ষ করার মতো। বৈশ্বিক বর্ণাভাষ আর সম সময়ের কাট ও প্যাটার্ন অনুসরণে চমৎকার সব ডিজাইন করেছে হাউসগুলো। অথচ দোকানের ঝাঁপ ফেলে, করোনাভয়ে সবাইকে গৃহবন্দী থাকতে হচ্ছে। আর নির্ভর করতে হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল শপে কেনাকাটার ওপর। এ ক্ষেত্রে সবার প্রস্তুতিও সমান নয়।
গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটা বড় অংশ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলেও অনেকেই আবার রয়েছে পিছিয়ে। তাদের জন্য, বলার অপেক্ষা রাখে না দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলানো দুরূহ হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রিটেইল ব্যবসার একটা বিরাট ভূমিকা আছে। বিশেষ ফ্যাশন এবং বিউটি ইন্ডাস্ট্রির মতো খাতগুলোও বিশেষ ভূমিকা রাখে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়; নারীদের একটা বড় অংশ এই দুটো ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত। ফলে অনেক পরিবার এই দুটো শিল্প খাতের উপর নির্ভর করে থাকে। কিন্তু এই অবরুদ্ধ পরিস্থিতি এই রিটেইল খাতকে ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় মুখে ঠেলে দিয়েছে। হুমকি মুখে রয়েছে এই খাতের একটা বড় অংশের অস্বিত্ব। বিষয়টি নীতিনির্ধারণী মহল যত বিবেচনায় নিবেন ততই মঙ্গল বলেই সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
নতুন বছরের প্রথম দিন তথা রোজার প্রথম দিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। সন্ধ্যা এগিয়েছে রাতের পথে। সময় যত গেছে, রাস্তাঘাট হয়েছে নিঝুম। চরাচর হয়েছে নিস্তব্ধ।
কোথাও নেই মানুষের প্রাণময় উপস্থিতি। নেই উচ্ছ্বাস ভরা কলরোল। নেই কোথাও উদ্যাপনের লেশমাত্র। নীরবতায় ভর করে আছে অদ্ভুত হতাশা আর শঙ্কা। সবার প্রার্থনায় আছে পরিস্থিতির উত্তরণ। সবাই প্রতীক্ষায় সুদিনের, প্রতীক্ষায় আশাময় আলোকরেখার। অধীর মঙ্গলবারতা শোনার। প্রত্যাশা হোক তাই মৃত্যু, শোক আর বিরহ দহন পেরিয়ে শান্তির আনন্দে অনন্ত জেগে ওঠার; প্রাণের নিত্যধারা প্রত্যাবর্তনের।