এত দ্রুত ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কারণ মাত্র পাঁচ মাস আগের ঘটনা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের খবর তখন বিশ্বজুড়ে চাউর হলেও ফ্যাশনের চার রাজধানী বিষয়টিকে সেভাবে পাত্তা দেয়নি। বরং ফ্যাশন উইক ঠিকঠাকমতোই অনুষ্ঠিত হয়েছিল নিউইয়র্ক, লন্ডন, মিলান ও প্যারিসে। নিউইয়র্ক আর লন্ডনে সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। তবে মিলানে আরমানির শো ছিল দর্শকশূন্য। আর প্যারিসে তিনি যাননি। মিলান আর প্যারিস আসরের পর অনেকেরই করোনায় আক্রান্তের খবর পাওয়া গিয়েছিল।
এরই মধ্যে বিশ্বকে বিস্রস্ত করে করোনা এখন কিছুটা দুর্বল। তবে প্রাণহানি ছাড়াও যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা অচিরেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। বরং বিশেষজ্ঞরা নানা অভিমত দিচ্ছেন। এরই মধ্যে ফ্যাশনের চার রাজধানী আবারও সরব হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে সীমাবদ্ধ পরিসরেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফ্যাশন উইক। ফ্যাশনের মাস শুরু হচ্ছে ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইক দিয়ে। এরপর ক্যারাভান প্রতিবারের মতো লন্ডন, মিলান হয়ে প্যারিসে গিয়ে থামবে ৬ অক্টোবর।
সপ্তাহের শুরুতেই সরগরম হয়ে উঠবে নিউইয়র্ক; তবে এবার একটু অন্যভাবে। নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকের আয়োজক কাউন্সিল অব ফ্যাশন ডিজাইনারস অব আমেরিকা (সিএফডিএ) তরফে জানানো হয়েছে, এবারের উইকের মাত্র ৬০টি ফ্যাশন হবে। অথচ গত ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ১৭৭টি। এবারের ফ্যাশন সপ্তাহ শুরু হবে ১৩ সেপ্টেম্বর জেসন উর শো দিয়ে। আর ১৭ সেপ্টেম্বর ক্রিশ্চিয়ান সিরিয়ানোর লাইভ শো দিয়ে পর্দা নামবে স্প্রিং-সামার ২০২১-এর।
নিউ নরমালে নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইককে দেখা যাবে নিউ লুকে, এমন অভিমত আয়োজকদের। সিএফডিএ এবারের ফ্যাশন উইককে বর্ণনা করেছে ‘ডিজিটাল অ্যাকটিভেশন’ হিসেবে। আর এই ভার্চ্যুয়াল কর্মকাণ্ডের নতুন নামকরণ হয়েছে ফিজিটাল। ইংরেজি ফিজিক্যাল আর ডিজিটালের মিলনে তৈরি হয়েছে এই নতুন শব্দ। এর অর্থ হলো ফ্যাশন উইকের বেশির ভাগ কার্যক্রমই হবে ভার্চ্যুয়াল, আর সেটা দেখা যাবে সিএফডিএর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রানওয়েথ্রিসিক্সটি এবং আইএমজির ওয়েবসাইট ও এনওয়াইএফডব্লিউডটকমে। এ ছাড়া ডিজাইনারদের সামাজিক মাধ্যমেও প্রচারিত হবে।
এবার মাইকেল করস ও প্রোয়েঞ্জা, অস্কার ডে লা রেন্টা, প্রবাল গুরুং, গ্যাব্রিয়েলা হার্স্টের মতো ব্র্যান্ড অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিলেও সিএফডিএর প্রধান নির্বাহী স্টিফেন কোলব জানিয়েছেন, ১৫টি নতুন আমেরিকান ব্র্যান্ড এবার অংশ নিচ্ছে। এবারের ফ্যাশন উইকের জন্য ৪০ পৃষ্ঠার স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করা হয়েছে। এই নিয়ম অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব মেনে কোনো শোতে ৩০ জনের বেশি দর্শক থাকতে পারবেন না। এর ফলে সব শোই হবে ফিজিটাল। আবার কোনো কোনো শো হবে পুরোপুরি ডিজিটাল। যেমন হারলেমের শো। অনেক ব্র্যান্ড অংশ নিলেও নতুন কালেকশন প্রদর্শন না করে বরং অন্য ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে। এর অন্যতম ক্যালোলিনা হেরেনা। এরা একটি ফিল্ম দেখানোর পাশাপাশি আলোচনা অনুষ্ঠান করবে।
এবারের আসরে জেসন উ আর রেবেকা মিনকফের ফিজিটাল উপস্থিতি থাকলেও ক্রিশ্চিয়ান সিরিয়ানোর উপস্থিতি হবে ভার্চ্যুয়াল। সিরিয়ানো তাঁর কানেকটিকাটের বাসা থেকেই শোতে অংশগ্রহণ করবেন এবং তাঁর সংগ্রহ উপস্থাপন করবেন।
গ্যাব্রিয়েলা হার্স্ট অবশ্য প্যারিসে যাবেন বলে মনস্থির করেছেন। উইকের মাঝখানে ১৫ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত থাকছে মেন’স ডে হিসেবে। এবারের আসরের অন্যতম আকর্ষণ অবশ্য ব্ল্যাক ইন ফ্যাশন ক্যাম্পেইন।
লন্ডন ফ্যাশন উইক অনুষ্ঠিত হবে ১৭-২২ সেপ্টেম্বর। এখানেও বস্তুত ফিজিটাল উইকই হবে। ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী ৫০টি সম্পূর্ণ ডিজিটাল এবং ২১টি ফিজিক্যাল এবং ডিজিটাল উপস্থাপনা এবং মাত্র ১০টি থাকবে কেবল ফিজিক্যাল উপস্থাপনা। তবে এই মিশ্র আসরে ব্রিটিশ ফ্যাশনের শীর্ষ অন্তত ৬০ জন ডিজাইনার নানা মাধ্যমে তাঁদের সৃজনকর্ম উপস্থাপন করবেন। লন্ডনে শুরু হবে বারবেরি দিয়ে আর শেষ রিচার্ড কুইনে। লন্ডনের প্রথম দিনের মূল আকর্ষণ অবশ্যই বারবেরি। কোনো দর্শক ছাড়াই আউটডোর উপস্থাপনা লাইভস্ট্রিমিং করা হবে। এই শোর নামই দেওয়া হয়েছে ‘বারবেরি ইন নেচার’।
ফিজিক্যাল শোর মধ্যে রয়েছে বেথানি উইলিয়ামস, হ্যালপার্ন ও মার্গারেট হাওয়েল। ভিভিয়েন ওয়েস্টউডের সংগ্রহ উপস্থাপিত হবে ফিল্মের মাধ্যমে। আবার ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম করবেন স্যালন শো। রোকসান্ডা, ক্রিস্টোফার কেন, ওসমান ইউসেফজাদা ও সুপ্রিয়া লেলে ফিজিক্যাল শো করবেন। শেষ দিনে শার্লট নাওয়েলস আর বিয়ানকা স্যান্ডারস ছবি দেখিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবেন। এরডেমের শো ফিজিক্যাল আর ডিজিটাল উভয়ই হবে। তবে উইক শেষ হবে রিচার্ড কুইনের ফিল্ম দিয়ে।
ইতালির ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অন্যদের মতোই ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই ক্ষতি পোষানোর জন্য দুটো পথ তাদের—ভার্চ্যুয়াল ইভেন্ট করা অথবা বাতিল করে দেওয়া। প্রথমটাকেই সবাই গ্রহণ করেছে। তবে এর পাশাপাশি ফিজিক্যাল শো এবার অন্য তিন শহরের মতো মিলানেও হচ্ছে। কারণ, বাতিল করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া ইতালির ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্যও বেশ কঠিন। গত বছর এই সময় পর্যন্ত যেখানে আয় ছিল ৭৬ বিলিয়ন ডলার, সেখানে এবার সেখানে ঘাটতি ইতিমধ্যেই ২০-৩০ শতাংশ হয়েছে। এখন লক্ষ্য হলো টিকে থেকে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া। তবে অন্য শহরগুলোর তুলনায় মিলান এবার কিছুটা সাহসী। কারণ ২৮টি ফ্যাশন হাউস ফিজিক্যাল শো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া আরও ২৪টি ডিজিটাল শো করবে ২৩ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর মিলানে অনুষ্ঠিত হবে মেন’স ও উইমেন’স ফ্যাশন উইকে।
ফিজিক্যাল শোগুলোর বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠিত হবে দর্শকশূন্য ভেন্যুতে। মিলানে পর্দা উঠবে মিসোনির ডিজিটাল প্রেজেন্টেশন দিয়ে। তবে ফিজিক্যাল শোর পক্ষে উচ্চকিত এলভিএমএইচ তাদের গ্রুপের অন্যতম ব্র্যান্ড ফেন্দির শো লাইভ করবে। একই দিনে একই পথে চলছে আলবার্তা ফেরেত্তি আর ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানাও। এদিকে এরই মধ্যে ফেন্দির মেয়েদের পোশাক বিভাগে ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ব্রিটিশ ডিজাইনার কিম জোনসকে।
এই আসরে আরও থাকছে মিউসিও প্রাদা, এম্পেরিও আরমানি, ম্যাক্সমারারা। এবারই প্রথম ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে প্রাদার হয়ে সংগ্রহ উপস্থাপন করবেন র্যাফ সিমনস। অনেক দিন পর মিলানে ফিরছেন বস। আছে রিসো আর মারনিও।
গেল মার্চের মতো এবারও লাইভস্ট্রিমিং করবে এম্পেরিও আরমানি। আর অধিক দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হবে আরমানির মূল শো। তাঁর এবারের সংগ্রহের শিরোনাম ‘অ্যান অড টু চায়না’। সমাপনী দিনে রয়েছেন প্যারিসের ডার্লিং ভ্যালেন্তিনো। তিনি পুরুষ ও নারীদের সংগ্রহ যৌথভাবে উপস্থাপন করবেন। অনেক বছর পর তিনি ফিরছেন মিলানে। তবে মিলানে এবার অনুপস্থিতির তালিকায় রয়েছে দুই মহা ব্র্যান্ড গুচি আর বোত্তেগা ভেনেতা। শোনা যাচ্ছে ভবিষ্যতে লাইভস্ট্রিমিং করবে গুচি।
২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় প্যারিস ফ্যাশন উইকের পর্দা উঠবে দিওরের লাইভ শো দিয়ে। পরের দিনের সূচিতে আছে বালমেঁ। তবে অলিভিয়ের রোনটেং অবশ্য সিন নদীতে নাও ভাসিয়ে অন্য রকম এক উপস্থাপনার পরিকল্পনা করেছেন।
এবার আরও আছে হারমিস, লুই ভুইতো, মিউ মিউ মেইসন মারজিয়েলা, গিভেনশি ফিজিক্যাল শো করলেও থম ব্রাউন, আলতুজারা এবং দ্রিস ভন নতেঁ থাকছেন প্রযুক্তিনির্ভর। তরুণদের মধ্যে প্যারিসে নিজেদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে উপস্থিত থাকছেন মারিন সেররে আর থেবে মাগুগু। আছেন কেনেথ ইজে, ওয়েলস বনার, আর নিউইয়র্কে অনুপস্থিত গ্যাব্রিয়েলা হার্স্ট।
একেকটি শো আয়োজনে অন্তত এক লাখ ডলার খরচ হয়। এবার অনুপস্থিত ব্যক্তিদের টার্নওভারে ইতিবাচক প্রভাব থাকলে সত্যি সত্যি ফ্যাশন উইকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। প্রশ্নবিদ্ধ হবে এই আসর আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে। এরই মধ্যে অনেক শীর্ষ ব্র্যান্ড নিজেরাই নিজেদের সংগ্রহ উপস্থাপনার পরিকল্পনা করেছে।
অনেকে আবার মৌসুমেই তাদের শো আয়োজনের পক্ষে। কেউ কেউ গত বছর সেটা করেছেও। এবার যদিও করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে হয়নি। তবে এরই মধ্যে বেশ কিছু ডিজাইনার ভার্চ্যুয়াল শো আয়োজন করে ফ্যাশন উপস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। এর মধ্যে কঙ্গোর ফ্যাশন ডিজাইনার আনিফা এমভুয়েম্বার শো রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। ভার্চ্যুয়াল উপস্থাপনা পরোক্ষে ব্যয় হ্রাসও করছে। সাংহাই, টোকিও এবং হেলসিঙ্কি ভার্চ্যুয়াল উইক আয়োজন করে সাড়া ফেলেছে। তাই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই ট্র্যাডিশন সমানে চলবে, নাকি নতুন মেরুকরণ হবে, তা সময়ই বলবে। আপাতত আবিশ্বের প্রত্যাশা মহামারি থেকে উত্তরণ।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, সিএফডিএ, ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিল, ইতালিয়ান ফ্যাশন কাউন্সিল ও ফেদারেসিওঁ দে লা ওত্ কতুর্।