বাংলাদেশের সৃজনশীল গয়না

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ নিজেকে সজ্জিত করতে বিভিন্ন ধরনের গয়না ব্যবহার করে আসছে। যুগে যুগে গয়নার গঠন, গড়ন, উপাদান ও ব্যবহারে এসেছে নানা পরিবর্তন। গয়না তৈরির জন্য মানুষ এখন কেবল সোনা, রুপা বা দামি পাথরের শরণাপন্নই হয় না; বরং নানা ধাতু, পুঁতি, কাঠ, রঙিন সুতা, মাটি, এমনকি নারকেলের খোল, শামুক–ঝিনুক, ঘাস ইত্যাদি  উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে গয়না তৈরিতে। এমনকি গয়না তৈরির ক্ষেত্রটা আজকাল বেশ নিরীক্ষাধর্মী হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়ে সৃজনশীল গয়না তৈরির প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন আমাদের দেশের জুয়েলারি ডিজাইনাররা। তেমনই দুটি সৃজনসাফল্যের গল্প শেয়ার করা হলো।

সিক্স ইয়ার্ড স্টোরি

জেরিন তাসনিম খান

জেরিন তাসনিম খান পড়তেন স্থাপত্যবিদ্যায়। হিসাব অনুযায়ী দালানকোঠা বা নানা স্থাপনার নকশা করার কথাই তাঁর। কিন্তু তিনি হাঁটলেন ভিন্ন পথে। ইট, কাঠ আর কংক্রিটের দালানের নকশার চেয়ে গয়নার নকশা করাই বেশি আনন্দের বলে মনে করলেন তিনি। এফ কমার্সের মাধ্যমে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে ছড়িয়ে দিতে হয়ে উঠলেন উদ্যোক্তা। ফেসবুকে নিজের পেজ ‘সিক্স ইয়ার্ড স্টোরি’ নিয়ে শুরু হলো পথচলা। যেখানে তাঁর স্বতন্ত্র নকশায় তৈরি বিভিন্ন গয়না মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ক্রেতাচাহিদা ও বিক্রি। মূলত পিতল ও তামার গয়না নিয়েই তিনি বেশি কাজ করেন, যার ওপর থাকে সোনা ও রুপার প্লেটিং। সোনা ও রুপার গয়না তৈরিতেও তিনি দক্ষ, তবে তা করে থাকেন গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী।

সিক্স ইয়ার্ড স্টোরির রয়েছে নিজস্ব দক্ষ কারিগর, যাঁরা তামা ও পিতলের কাজে পারদর্শী। ক্রেতার সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে কারিগরেরাও বদ্ধপরিকর। তাঁরা প্রত্যেকেই যথাসাধ্য পরিশ্রম করেন যেন প্রতিটি গয়না ক্রেতাদের হাতে পৌঁছায় সর্বোচ্চ গুণগত মানসম্পন্ন হয়ে, বলছিলেন জেরিন। ক্যাজুয়াল গয়না থেকে উৎসবের গয়না—সবকিছুই তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বিয়ের গয়নাও। অনেক বিয়ের কনেরাও তাঁদের বিশেষ দিনটির জন্য বেছে নিচ্ছেন তাদের নকশা করা গয়না। এ পর্যন্ত শতাধিক কনের গয়না নকশা করেছে সিক্স ইয়ার্ড স্টোরি। তাদের গয়নার মূল প্রচারটা হয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। তারা তাদের প্রতিটি কালেকশন ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরেন ফটোশুটের মাধ্যমে। সিক্স ইয়ার্ড স্টোরি বিশ্বাস করে সৌন্দর্য কোনো বিশেষ বর্ণ বা শারীরিক গঠননির্ভর হতে পারে না। তাই তারা তাদের গয়নার ফটোশুটে সব ধরনের ত্বকবর্ণ ও শারীরিক গড়নের মডেল নিয়ে কাজ করে।

একটা ফেসবুক পেজ থেকে শুরু হওয়া এই ব্যবসা আজ হাঁটি হাঁটি পা পা করে অনেকটাই পূর্ণতা লাভ করেছে। জেরিনের সিক্স ইয়ার্ড স্টোরির এখন নিজস্ব অফিস রয়েছে। তাঁর অধীনে এখন ১৮ জন কর্মীও কাজ করছেন। করোনাকালে তাঁদের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ, গয়না তৈরির অনেক প্রয়োজনীয় কাঁচামালই আমদানিনির্ভর। বর্তমানে আমদানির ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ থাকায়, সেসবের অভাব দেখা দিয়েছে বাজারে। আর এ কারণে বারবারই পরিবর্তন করতে হচ্ছে গয়নার পরিকল্পিত ডিজাইনগুলো।

তবু তাঁর কারিগরেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন কম রসদেও সবচেয়ে সেরা ডিজাইনের অলংকার তৈরি করতে। চলার পথে চড়াই-উতরাই আসবেই। আর এতে থেমে যাওয়ার মানুষ নন জেরিন। স্বপ্নবাজ এই তরুণী প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছেন আপন গতিতে। স্বপ্ন দেখেন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সিক্স ইয়ার্ড স্টোরি একদিন গোটা বিশ্বে সুনাম কুড়াবে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আমাজনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। তাই তাঁদের তৈরি গয়না এখন আমাজনেও পাওয়া যাচ্ছে।

গ্লুড টুগেদার

মেহনাজ আহমেদ আদিবা

মেহনাজ আহমেদ আদিবার গ্লুড টুগেদারের যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালে। নিজস্ব ডিজাইনের হাতে তৈরি বিভিন্ন গয়না নিয়ে কাজ করে পেজটি। ট্র্যাডিশনাল গয়না সব সময়ই ভীষণভাবে টানত আদিবাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সব উৎসব অনুষ্ঠানে ট্র্যাডিশনাল গয়না পরাটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে জন্য তিনি চেষ্টা করতে থাকেন, ট্র্যাডিশনাল গয়নায় একটা আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে। ট্র্যাডিশনাল ও ওয়েস্টার্ন গয়নার একটা ফিউশন ঘটাতে। এমন কিছু গয়না তৈরি করতে, যা দেশি ও পাশ্চাত্য সব ধরনের পোশাকের সঙ্গেই খুব সহজে মানিয়ে যায়। সে লক্ষ্যেই ‘গ্লুড টুগেদার’–এর গয়নাগুলো বাজারজাত করা।

এর সব গয়নাই তাঁর নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি এবং সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় গয়নাশিল্পীদের হাতেই তৈরি। ভারতীয় গয়না এ দেশের বাজারে ঢোকার পরে আমাদের স্থানীয় কারিগরদের অনেককেই হিমশিম খেতে হয়েছে। এসব ভারতীয় গয়নার বেশির ভাগই যন্ত্রে তৈরি। তাই অতি দ্রুত অনেক বেশি গয়না উৎপাদন করা যায়। আমাদের কারিগরেরা এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে না পারায় অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দেন। বাংলাদেশে তাই এখন হাতে তৈরি কাস্টমাইজড জুয়েলারি নিয়ে কাজ করেন এমন কারিগরের সংখ্যা বেশ কম। গ্লুড টুগেদার এই কারিগরদের কাজ করার প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। তারা বিশ্বাস করে, এই কারিগরেরা আমাদের সম্পদ এবং তাঁদের রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের। হাতে তৈরি গয়না প্রস্তুত করার জন্য অভিজ্ঞতা ও যত্নের প্রয়োজন। প্রতিটি গয়না প্রস্তুত হতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় লেগে যায়।

তাই তিনি বিশ্বাস করেন, যন্ত্রের তৈরি গয়নার চেয়ে এর মূল্য অনেক বেশি। কারণ, তাঁদের গয়নাগুলো নিজস্ব ডিজাইনারের এবং সম্পূর্ণ হাতে তৈরি। তাই সব সময় তাঁরা চেষ্টা করেন তাঁদের গয়নায় একটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে। গয়না তৈরির জন্য এমন সব পাথর ও পুঁতি ব্যবহার করেন, যা সচরাচর বাজারে পাওয়া যায় না। গ্লুড টুগেদারের গয়না পরতে পারেন আট থেকে আশি বছরের যে কেউ।

অনেক বিয়ের কনেদের জন্যও তারা কাস্টমাইজড গয়না প্রস্তুত করেছে। শুরু থেকে এই পর্যন্ত গ্রাহকদের অপরিসীম ভালোবাসায় তারা আপ্লুত। সেই ভালোবাসার জোরেই ফেসবুকের ছোট্ট অনলাইন শপটির আজ বনানীর ১২ নম্বর সড়কে রয়েছে নিজস্ব আউটলেট। শুধু তা–ই নয়, নিজেদের ওয়েবসাইট নিয়েও কাজ করছে তারা। অতি দ্রুতই গ্লুড টুগেদার তাদের গয়না রপ্তানি করবে অন্যান্য দেশেও।

ছবি: সিক্স ইয়ার্ড স্টোরি ও গ্লুড টুগেদার