ক্যাপিটল হিলে স্বাগত জানানো হয়েছে নতুন অতিথিদের। এরই মধ্যে দিয়ে আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনাও হয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের নতুন দায়িত্বে অভিষেকের পর বেশ খানিকটা সময় গড়িয়েছে। আর আলোচনায় এখনো রয়েছে তাঁদের সাজ ও পোশাক। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুখে যতই আমেরিকাকে মহান করার কথা বলুন, তাঁর উত্তরসূরিরা কেবল কথায় নয় তাঁদের চলন-বলন আর পোশাক-আশাকেও স্বদেশপ্রেমের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
বিশিষ্ট ফ্যাশন লিখিয়ে আর বোদ্ধারা মেতেছেন তাঁদের পোশাকের অন্তর্নিহিত অর্থের বিশ্লেষণে। কারণ জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস, কেউই শুধু পরার জন্য ডিজাইনার ড্রেস পরেননি। বরং সেই পোশাকের মধ্য দিয়ে তাঁরা দিয়েছেন নানা বর্ণ, নানা মত, নানা ভাষা নিয়ে গড়া আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভেদের মধ্যে মহামিলনের বার্তা।
দুই পুরুষের প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক। একদিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, অন্যদিকে সেকেন্ড জেন্টলম্যান ডাগলাস এমহফ, উভয়ই একই ডিজাইানারের ওভারকোট, সুট আর মাস্ক পরেছেন। আর সেই ডিজাইনার হলেন র্যালফ লরেন । ইহুদি অভিবাসী পরিবারের সন্তান র্যালফের জন্ম ব্রঙ্কসে। তাঁর পোশাক নকশায় তিনি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বুনে চলেছেন আমেরিকার স্বপ্ন।
যুক্তরাষ্ট্রে অলিম্পিক দলের পোশাকও নকশা করেছেন তিনি। তাই র্যালফের পোশাক নিছক পরার জন্য যে নয়, সেটা স্পষ্ট। নির্বাচনী প্রচারণা থেকেই বিষয়টি টের পাওয়া যাচ্ছিল। কারণ তাঁরা বারবারই উচ্চারণ করেছেন, আমেরিকা ফার্স্ট। মার্কিন ফ্যাশন ডিজাইনার র্যালফ লরেনকে বেছে নেওয়ার মধ্যেও যেন ছিল সেই কথা রাখার বিষয়।
ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন পরেছেন আকাশি নীল টুইড কোট, ভেলভেট কাফ আর তাঁর পোশাকের জমিন অলংকৃত হয়েছে সারাভস্কি ক্রিস্টালে। অনুষঙ্গ হিসেবে সঙ্গী হয়েছে মুক্তা। সঙ্গে ম্যাচ করা মাস্ক।
তিনি পরেছিলেন কলোরাডোয় জন্ম নেওয়া ডিজাইনার আলেকজান্ড্রা ও’নিলের পোশাক। তাঁর লেবেল মারকারিয়ান। এখানেও স্পষ্ট ছিল ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বার্তা। একটু বলে রাখা ভালো, মাত্র ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত মারকারিয়ানের সেলিব্রিটি ক্লায়েন্টদের তালিকায় রয়েছে লিজ্জো, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া জোনাস, কেট হাডসনরা।
ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস মানেই যেন ফ্যাশনের শেষ কথা। তিনি যেটাই পরেন, সেটাই স্টেটমেন্ট হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রতীক নারীশক্তির। নিজেকে সেভাবেই প্রতীয়মান করেছেন নির্বাচনী প্রচারণাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাই তো তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এদিন দর্শকেরাও পরেছিলেন তাঁর প্রিয় কনভার্স। এমনকি যাঁরা বাড়িতে বসে অনুষ্ঠান দেখেছেন, তাঁরাও। সঙ্গে আরও ছিল তাঁর প্রিয় মুক্তা। আর তিনি? পার্পল ড্রেসের সঙ্গে কোট পরেছিলেন।
তাঁর জন্য এই পোশাক তৈরি করেছেন বেটা রোজ, লুইজিয়ানার ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিস্টোফার জন রজার্স, ২০১৯ সালের সিএফডিএ/ভোগ ফ্যাশন ফান্ড অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী। এমনকি সম সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থাকা তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ-মার্কিন ফ্যাশন ডিজাইনার হলেন রজার্স। তিনি এর আগে পোশাক নকশা করেছেন সাবেক ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, রিহানা আর বিয়ন্সের জন্য। প্রগাঢ় রং আর নাটকীয় শিলুয়েটের জন্য বিখ্যাত রজার্স অবশ্য ভাইস প্রেসিডেন্টের জন্য তৈরি পোশাকে তেমন নিরীক্ষায় যাননি। এদিন তিনি পরেছিলেন আরেক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরকিান ডিজাইনার সার্জিও হাডসনের পোশাক। কোভিড ১৯ মেমোরিয়াল ইভেন্টে।
মুক্তা ছাড়া ভাইস প্রেসিডেন্টের সাজ সম্পূর্ণ নয়। তাই তো কেবল গলায় নয় কর্ণলতিকাতেও শোভা পেয়েছে তাঁর সিগনেচার অনুষঙ্গ। আর সেটা ছিল পুয়ের্তো রিকান ডিজাইনার উইলফ্রেডো রোসাডোর নকশা করা।
কমলা হ্যারিসের কন্যা এলা এমহফও তাঁর ফ্যাশন সচেতনতার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন। তাঁকে দেখা গেছে মিউ মিউ কোটে। সাদা উপরের কলারের এই কোটে ছিল চমৎকার অলংকরণ।
কেবল ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসই নন, এদিন আরও দুজন সাবেক ফার্স্ট লেডি পরেছেন পার্পল রঙের পোশাক—মিশেল ওবামা আর হিলারি ক্লিনটন। প্রথমজনের পোশাক নকশা করেছেন সার্জিও হাডসন। আর দ্বিতীয় জনের র্যালফ লরেন।
পার্পল অন্যদিকে লাল ও নীলের সংকর। সেখানে বলাই যায় পার্পলে উপস্থিত ডেমোক্র্যাটদের নীল আর রিপাবলিকানদের লাল। এই পার্পল আবার মার্কিন নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলনেরও রং।
পরিশেষে তারকাদের প্রসঙ্গ। লেডি গাগা পরেছিলেন লাল সিল্কের ঢিলেঢালা স্কার্টের সঙ্গে নেভি নীল ক্যাশমেয়ার জ্যাকেট। আর ঠোঁটে জলাপাই শাখা ধরা সোনালি রঙের পায়রা ছিল জ্যাকেটে বসানো। টেক্সাসের ডিজাইনার ড্যানিয়েল রোজবেরি এই পোশাক নকশা করেন বিখ্যাত ফরাসি ফ্যাশন ব্র্যান্ড শিয়াপারেলির হয়ে।
এদিন আরেক কণ্ঠশিল্পী জেনিফার লোপেজ আপাদমস্তক সজ্জিত ছিলেন শানেলে। তিনি পরেছিলেন সম্পূর্ণ সাদা পোশাক। এই সাদা কিন্তু মার্কিন নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলনেরও রং।
গেল নভেম্বরে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বিজয় ভাষণেও কিন্তু ছিলেন শুভ্রবসনা। এদিন জে লো পরেন শ্যানেলের সোনালি বোতাম দেওয়া টুইড লংকোট, রাফেলড ব্লাউজ ও চওড়া ঘেরের প্যান্ট, মুক্তা বসানো ব্রেসলেট আর স্টেটমেন্ট ইয়ারিং। তিনি সাজের সঙ্গে মিলিয়ে চুল করেছিলেন পনিটেল।
তরুণ কবি আমান্ডা গরম্যান পরেছিলেন উজ্জ্বল হলুদ রঙের প্রাদা কোট।
পোশাক প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় বলতে হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে মহান বানানোর কথা বললেও গেল চার বছরে ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প কিন্তু আমেরিকান ডিজাইনারদের পোশাক পরেছেন কালেভদ্রে।
বরং তিনি অনুরক্ত ছিলেন ইউরোপিয়ানদের। তাঁকে পরতে দেখা গেছে শ্যানেল, ডলচে অ্যান্ড গ্যাবানা।
পক্ষান্তরে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে কথা ও কাজের মিল। সূচনা রাতের পোশাকেও বিষয়টি ছিল স্পষ্ট।
সূত্র: সিএনএন, ভোগ, নিউইয়র্ক টাইমস