সারা দুনিয়াতেই করোনার ঢেউ এসে, সব সময় বাইরে যাওয়া, বাইরের পোশাক পরা, বাইরের উপযোগী সাজগোছের গুরুত্ব কমিয়ে আনছে। দিনের একটা বড় সময় এখন মানুষ ঘরে কাটায়। হোম অফিস, অনলাইন ক্লাস, জুম মিটিং, অনলাইন ইন্টারভিউ বা ভিডিও কনফারেন্সে আত্মীয়–বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথন বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই পরিচিত ব্যাপার ঘরে ঘরে। তবে সেই সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী চাকরি বা ব্যবসার খাতিরে হোক অথবা দরকারি বাজার সদাই, কেনাকাটা ও সীমিত পরিসরে পারিবারিক বা অফিশিয়াল অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য হোক, বের আমাদের হতেই হয়। তাই ঘরে ও বাইরে সামনের বছর সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে ফ্যাশনের গতিবিধির নিরিখে। দেখা যাচ্ছে, ২০২১–এর ফ্যাশনের পূর্বাভাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
এদিকে আরামদায়ক, স্বস্তিকর পোশাক ও ব্যবহারের দিক থেকে উপযোগী বিভিন্ন অনুষঙ্গই সবার পছন্দের শীর্ষে থাকার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে নতুন বছরে। এবার ২০২১–এর সম্ভাব্য প্রধান ফ্যাশন ট্রেন্ডগুলো দেখে নেওয়া যাক।
স্বস্তিকর ও আরামদায়ক পোশাকই মূলত ফ্যাশন দুনিয়া কাঁপাতে যাচ্ছে সামনের বছর। ফিরে আসছে ব্যাগি জিনস ও ঢিলেঢালা ট্রাউজার। করোনার এই সময়ে অস্বস্তিকর এবং পরতে কষ্টকর, এ রকম জামাকাপড় মানুষ একেবারেই কিনতে ও পরতে চাচ্ছে না বিশ্বজুড়েই। সেকুইন্স বসানো অথবা অতিরিক্ত আঁটসাঁট দম আটকানো ফিটিংসের জামাকাপড় তাই মনে হচ্ছে তোলাই থাকবে এ বছর। সুতি কাপড়, যাতে ত্বক শ্বাস নিতে পারে, ধোয়া ও শুকানো সহজ, শীতে করোনার প্রকোপ বাড়ার ভয়ে উষ্ণতার সাহস দেওয়া উলের বোনা কাপড় এসবই এখন দুনিয়াজুড়ে সবার পছন্দের তালিকার শীর্ষে।
মাস্ক যে এখন একটি প্রধানতম ফ্যাশন অনুষঙ্গ, তা নিয়ে আর কোনোই সন্দেহ নেই। নো মাস্ক নো সার্ভিসের বাধ্যবাধকতায় আর মহামারি থেকে বাঁচার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হিসেবে ঘরের বাইরে মাস্ক পরার আর কোনো বিকল্প নেই কোথাও। তাই সময়ের প্রয়োজনেই এ বছর মাস্ক হয়ে উঠবে অত্যাবশ্যক ফ্যাশন অনুষঙ্গ। বর্ণিল, মজার মজার মেসেজ বা থিমনির্ভর মাস্কের সঙ্গে সঙ্গে, ফ্যাশন সচেতন মানুষ ইদানীং একরঙা কালো মাস্কের দিকে ঝুঁকছে। কালো ব্যাগ বা কালো জুতার মতোই কালো মাস্ক নারী-পুরুষ নির্বিশেষের ফ্যাশন অনুষঙ্গ বলে বিবেচিত হচ্ছে। বৈচিত্র্য আনতে তিন স্তরের ফেব্রিক মাস্কের ওপর মসলিন বা নেটের স্তর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া হাইতির মাস্কগুলোর বাইরের লেয়ারটি কালো সিল্ক দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে, যা দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এদিকে মাস্কের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের মাস্ক চেইন ব্যবহার করা এখন আসন্ন ট্রেন্ডগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে।
চুল ও মাথাকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করাই মূল উদ্দেশ্য হলেও মাথার স্কার্ফে বৈচিত্র্য আনা যায় নির্দ্বিধায়। মেয়েরা একরঙা আর ফুলেল প্রিন্টের স্কার্ফের দিকে আগ্রহ দেখালেও ছেলেদের ব্যান্ডানা বা পট্টির ক্ষেত্রে মজার মজার প্রিন্ট এমনকি সুপারহিরো থিমের ডিজাইনও দেখা যাচ্ছে।
সময়ের ফেরে ঘুরেফিরে সেই নেটের কাপড় আবার প্রবেশ করতে চলেছে ফ্যাশন দুনিয়ায় জোরেশোরে। মাস্ক, মেয়েদের লম্বা মোজা বা টাইটস, হ্যান্ড গ্লাভস, ড্রেস অথবা টপস, সব জায়গাতেই নেট ফেব্রিকের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। এমনকি জিনস ও টি–শার্টের ওপরে কিছুটা লম্বা, হাতকাটা কোটির মতো পরার ফ্যাশন এখন খুবই আগ্রহ জাগাচ্ছে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে।
মহামারির দুর্বিষহ আর বিবর্ণ ২০২০ সালকে বিদায় দিচ্ছে ফ্যাশন দুনিয়া। আতঙ্ক নয় সচেতনতা, ভয় নয় আশা—এই সব বার্তা নিয়েই দেখা যাচ্ছে বড় বড় ফ্যাশন হাউসগুলোতে উজ্জ্বল রং, যেমন রাজকীয় নীল বা রানি গোলাপি রঙের বসন–ব্যসনের মেলা। ফুলেল ছাপা ও এমব্রয়ডারির প্রাধান্য সামনের বছর আরও বৃদ্ধি পাবে, এমনটাই ভাবছেন ফ্যাশনবোদ্ধারা। এমনকি জ্যাকেট বা জিনসের ডেনিমেও আঁকিবুঁকি, ডাই, ব্লক, রঙিন সুতার কাজ দেখা যাচ্ছে।
ঘরে পরার চপ্পল বা স্লিপারের দিকে মনোযোগ বেড়েছে ফুটওয়্যার কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে। মজার ও আরামদায়ক ডিজাইনের ফ্লিপ ফ্লপ এখন ভবিষ্যতের ফ্যাশন ট্রেন্ড। সেই সঙ্গে আরামদায়ক স্পোর্টস শুরুর দিকে সবার আগ্রহ আরও বাড়বে। কারণ, বিশ্বব্যাপী সবাই এখন বাইরে গিয়ে জগিং বা হাঁটার গুরুত্ব এই সময়ে আরও বেশি করে অনুধাবন করছে।
বাসায় পরার পোশাক এবং রাতপোশাকের ক্ষেত্রে এত বৈচিত্র্য আর মনোযোগ মনে হয় আর কখনো ফ্যাশন দুনিয়া দেখেনি। বড় বড় ফ্যাশন হাউসগুলো পায়জামা সেট, আরামদায়ক ড্রেস তৈরি করছে নতুন বছরেও সবার আপাতত ঘরে থাকার প্রবণতাকে উৎসাহ দিতে গিয়ে। সুতি, পিউর সিল্ক, নিট ফেব্রিক এবং সাটিন কাপড় ব্যবহার হচ্ছে এই সব পোশাকে। আর্টিফিশিয়াল তন্তু বাদ দিয়ে প্রাকৃতিক কাঁচামাল এখন পোশাকশিল্পে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, আই প্রোটেক্টরসহ কত কিছুই না নিয়ে যেতে হচ্ছে বাইরে বেরোলে আজকাল। সে জন্যই বোধ হয় ওভারসাইজড টোটে ব্যাগ বা হাতব্যাগ ফিরে এসেছে ফ্যাশন দুনিয়ায়। অ্যাকসেসরিস যদি কাজেই না লাগল, তবে কি আর লাভ বলুন! তাই দেখনদারি সর্বস্ব ক্লাচ ব্যাগের দিন ফুরিয়ে বড় ব্যাগ রাখাই এখন ফ্যাশনেবল। আবার এদিকে, ফেন্দি বা গিভেঞ্চির মতো ফ্যাশন হাউসগুলোর বাইরের পোশাকের সঙ্গে পানির বোতল রাখার হোল্ডারযুক্ত ছোট্ট ব্যাগ দেখা যাচ্ছে, যাতে কোনো কোনোটিতে হালকা স্ন্যাক্স রাখারও ব্যবস্থা আছে। করোনার সময়ে বাইরে গিয়ে নিজের বাড়ি থেকে আনা পানি ও খাবার খেতে উৎসাহিত করতেই এই ব্যবস্থা।
নতুন বছরের ফ্যাশন যেন মহামারির আতঙ্কের মধ্যেও আমাদের কাছে মুক্তি আর আশার আলোর প্রতীক। সারা বিশ্বেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার যে প্রত্যয় মানুষের মধ্যে এসেছে, তাই আরও দৃঢ় রূপ নেবে সামনের দিনে পোশাক–আশাক আর অনুষঙ্গের উপযোগিতায়, এমনটাই বলছে আগামী দিনের ফ্যাশনের পূর্বাভাস।