ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের শুরুটা ছিল গত বছর। সেই ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই ফ্যাশন উইকের দ্বিতীয় আসর। ২৩ থেকে ২৫ জানুয়ারি বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার সরগরম থাকবে ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০২০ উপলক্ষে।
এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে এটাই ফ্যাশনের সবচেয়ে বড় আয়োজন। আর তিন দিনের ফ্যাশনে উৎসবকে ঘিরে আয়োজনস্থল মুখর থাকবে নগরীর ফ্যাশনিস্তাদের উপস্থিতিতে। হাজির থাকবেন ফ্যাশন অনুরাগী থেকে ডিজাইনার, সেলিব্রিটি থেকে করপোরেট কর্মকর্তা আর ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ছাত্ররা। অবশ্য এই শিল্পের ভেতরের মানুষ আর বিশেষজ্ঞরা তো থাকবেনই।
বিশ্বের ফ্যাশন ক্যাপিটালগুলোতে ট্রেসেমের অবস্থান দৃঢ়। নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উইকে এই হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ডের উপস্থিতি ব্যাকস্টেজে। বাংলাদেশে সরাসরি ফ্যাশন উইক আয়োজনের সঙ্গে যোগ রয়েছে। এ নিয়ে কথা হচ্ছিল ইউনিলিভারের বিউটি অ্যান্ড পারসোনাল কেয়ারের মার্কেটিং ডিরেক্টর নাফিস আনোয়ারের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আসলে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি) আয়োজিত খাদি উৎসব থেকেই রয়েছে ট্রেসেমে। তবে গত বছর এই আয়োজনের দায়িত্ব এফডিসিবি আমাদের ওপর ন্যস্ত করে। ফলে পৃষ্ঠপোষক থেকে আয়োজকের ভূমিকায় রূপান্তরিত হতে হয়েছে।’ অবশ্য ট্রেসেমে যে তার অবস্থানেই আছে সেটাও জানিয়েছেন। কারণ ব্যাকস্টেজে থাকছে মূল উপস্থিতি।
এ জন্য গত বছরের মতো এবারও থাকছে আলাদা তিনটি ট্রেসেমে কিউ। এর মধ্যে দিয়ে ট্রেসেমের উদ্দেশ্য অর্থাৎ #ডুইটফরইউ এই বক্তব্যকে তুলে ধরা হচ্ছে। এ জন্য এবার মডেলরা নয়, ট্রেসেমের তিনটি কিউতে প্রকৃত পেশাদাররাই র্যাম্পে পা মেলাচ্ছেন।
এই তালিকায় আছে সংগীতশিল্পী জেফার, ফুটবলার মৌসুমী, অভিনয়শিল্পী ও উপস্থাপক নাবিলা, সংবাদপাঠক তরি, পাইলট মালিহা, নৃত্যশিল্পী হৃদি শেখ, অভিনয়শিল্পী সুনেহরা ও চিকিৎসক তানজিনা ইয়াসমিন।
তিন দিনে ট্রেসেমের তিনটির কিউর জন্য থাকছে তিনটি পৃথক থিম। প্রথম দিনের বিষয় রিয়েল ইউ, দ্বিতীয় দিন পার্টি আর তৃতীয় দিন ভ্যাকেশন। প্রথম দিনের ট্রেসেমে কিউর মেকওভার আর হেয়ার করছেন রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। একজনের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলা তথা প্রকৃত মানুষটাকেই সামনে নিয়ে আসার কাজটা করবেন তিনি।
ফ্যাশন উইকের প্রথম দিনে দশ জন ফ্যাশন ডিজাইনার তাদের সংগ্রহ উপস্থাপন করবেন। এই তালিকায় আছেন বাংলাদেশের ৭ জন আর তিনজন বিদেশি।
সূচনা দিনের বাংলাদেশি ডিজাইনাররা হলেন: নওশিন খায়ের, রিমা নাজ, তেনজিং চাকমা, রিফাত রহমান, তাসফিয়া আহমেদ, সাদিয়া হোসেন মিশু ও আফসানা ফেরদৌসী। এদের সঙ্গে আছেন ভারতের অনুজ শর্মা ও রিধি জৈন আর নেপালের অজয় গুরুং। এই দশ জন ডিজাইনার তাদের পোশাক সংগ্রহের জন্য যেভাবে চাইবেন সেভাবেই লুক তৈরির দায়িত্বও পালন করবেন বলে জানালেন আফরোজা। তবে তিনি মনে করেন, তাঁর চ্যালেঞ্জ হলো প্রকৃত তুমি বা রিয়েল ইউকেই ফুটিয়ে তোলা।
দ্বিতীয় দিন ট্রেসেমে কিউর বিউটি এক্সপার্ট ফারজানা শাকিল। তিনি ফুটিয়ে তুলবেন পার্টি লুক। আর এর সঙ্গে মডেলদের মেকওভার তো আছেই। তাঁকে কাজ করতে হবে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার ডিজাইনারদের সঙ্গে। এদিনও থাকছেন ৭ জন বাংলাদেশি ও ৩ জন বিদেশি। দেশি ডিজাইনারদের তালিকায় আছেন শৈবাল সাহা, ফারাহ আনজুম বারী, মাহিন খান, এমদাদ হক, মারিয়া সুলতানার মুমু, রুপো শামস ও শাহরুখ আমীন। আর বিদেশি তিনজন হলেন অন্তর-অগ্নি ও সৌমিত্র মণ্ডল আর সোনালী মেরি ফার্নান্দো।
পার্টি বা অনুষ্ঠানের রয়েছে নানা মাত্রা নানা রং। এর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সাজকে নানামাত্রিক করে তোলার অবকাশ থেকেই যায়। সেই প্রয়াস থাকবে বলেই জানালেন ফারজানা শাকিল। দেশের শীর্ষ সারির এই রূপবিশেষজ্ঞ আরও জানালেন যে, ট্রেসেমের আন্তর্জাতিক মানকেই অনুসরণ করতে চান তিনি।
তিন দিনের ফ্যাশন উইকের পর্দা নামবে ২৫ জানুয়ারি শনিবার। আর সমাপনী দিনের লুক তৈরির দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খানের ওপর। ট্রেসেমে কিউয়ের জন্য তিনি বিভিন্ন পেশাজীবীদের সাজাবেন অবকাশ যাপনের মুডে। কারণ এদিনের বিষয়: ভ্যাকেশন, অর্থাৎ ছুটি। আর ছুটি কাটাতে যাওয়ার সময় এক ধরনের লুক থাকে। অবস্থানের সময় সকাল, দিন আর রাতে থাকে আলাদা আলাদা মেজাজ। সেই অনুযায়ীই লুক তৈরি করবেন বলে জানান কানিজ আলমাস খান। এবারের আসর নিয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। বললেন, ছুটির মেজাজে থাকলে সবাই একটু ক্যাজুয়াল থাকার চেষ্টা করে। ফলে চুল নিয়ে তেমন কিছু করার থাকে না। তবুও এরই মধ্যে নতুনত্ব আনা, ছুটির মুডেও ব্যক্তিত্বভেদে একেকজনকে তাঁর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উপস্থাপন করা। আর মেকআপে ফুটিয়ে তোলা হবে নির্ভার, আনন্দিত ভাব।
কানিজ আলমাস খান শেষদিনে মডেলদের প্রস্তুত করবেন ১০ জন ডিজাইনারের জন্য। এই তালিকায় আছেন বাংলাদেশের লিপি খন্দকার, কুহু, চন্দনা দেওয়ান, সারাহ করিম, রিফাত রেজা রাকা, ফারাহ দিবা ও ফাইজা আহমেদ। এ ছাড়া থাকছেন ভারতের অলকা শর্মা ও আসিফ হাজার শেখ ও ভুটানের চন্দ্রিকা তামাং।
ফ্যাশন উইকের দ্বিতীয় আসরের আয়োজন নিয়ে কথা হয় এফডিসিবি প্রেসিডেন্ট মাহিন খানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এবারের বিদেশি ডিজাইনারদের সবাই দক্ষিণ এশিয়ার। অর্থাৎ এই সার্ক অঞ্চলের। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের। এর আগের আসরে কিংবা তারও আগে খাদি উৎসবের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ডিজাইনার এসেছিলেন।
গত বছর পর্যন্ত এই আসরে অংশ নিয়েছেন মালয়েশিয়ার স্থপতি থেকে ফ্যাশন ডিজাইনার এড্রিক অং। এবার তিনি নেই। নেই ইন্দোনেশিয়ার বা থাইল্যান্ডের কোনো ডিজাইনার।
আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রুচি, খাদ্যসংস্কৃতি ইত্যাদি নানা দিক থেকে রয়েছে প্রচুর মিল। এ জন্যই প্রতিবেশী দেশের ডিজাইনারদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানান মাহিন খান। যোগ করেন, প্রতি বারের মতো এবারও বাংলাদেশের ডিজাইনারদের জন্য থাকছে নির্দিষ্ট থিম।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকজ নকশাকে কাপড়ের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস এফডিসিবির ডিজাইনাররা করে থাকেন। বাংলাদেশের শেকড়কে সবার সামনে তুলে ধরাই তাদের লক্ষ্য। এর মধ্যে দিয়েই তাঁরা বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে চান বলেই অভিমত মাহিন খানের। এফডিসিবি প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, নতুন বছরে নতুন লুক আর ট্রেন্ডকে প্রতীয়মান করাই এই ফ্যাশন উইকের উদ্দেশ্য। এবারও সেটা হবে বলে আশা করছেন তিনি।
ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের দ্বিতীয় আসরে কোনো নতুন মুখ না থাকলেও, আগামী বছরে তার প্রত্যাশা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, অন্তত কয়েকজন প্রতিভাবান ডিজাইনারের কাজ রানওয়েতে দেখা যাবে, যারা এই সময়ের ফ্যাশনের দাবি মেনে সৃষ্টিশীলতা প্রদর্শন করছেন।
এমন দুজন ডিজাইনার সাদিয়া রশিদ ফেলে দেওয়া বিভিন্ন বস্তু যেমন কাগজের কাপ আর হোসনা এমদাদ স্বর্ণা রসুন ও পেঁয়াজের খোসা নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের তৈরি নিরীক্ষাধর্মী পোশাকে মডেলদের দেখা যাবে রেড কার্পেটে। তাদের মূল সংগ্রহ এ বছর রানওয়েতে থাকছে না থাকলেও মাহিন খানের বক্তব্য অনুযায়ী আগামী বছর হয়তো তারা অন্দরে প্রবেশ করতে পারবেন।
ইউনিলিভারের বিউটি অ্যান্ড পারসোনাল কেয়ারের মার্কেটিং ডিরেক্টর নাফিস আনোয়ারের বক্তব্যে রয়েছে একই অনুরণন। কারণ ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের মাধ্যমে ডিজাইনাররা নিজেদের সৃজনশীলতা উপস্থাপন করছেন। এটাই হয়তো তাদের বৃহত্তর ক্ষেত্রে পা রাখার সুযোগ করে দেবে। সে ক্ষেত্রে ইউনিলিভারও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে। এফডিসিবি ও ইউনিলিভারের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই আসর ঢাকার ফ্যাশন অনুরাগীদের নতুন সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা দেবে।
পাশাপাশি এই ফ্যাশন উইক বর্তমানে যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের জন্য তো বটেই, উদীয়মান ফ্যাশন ডিজাইনারদের জন্যও এটা একটা উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম বলে মনে করছেন নাফিস। কথায় কথা তিনি আরও জানিয়ে দিলেন, এবারের আসরে থাকছে একটা বিশেষ চমক। বাংলাদেশে নতুন একটি স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড তাঁরা শুরু করতে যাচ্ছেন।
ট্রেসেমে ফ্যাশন উইকের ট্যাগলাইন: ‘রানওয়ে অব লাইফ’। জীবনের এই জয়গানকে অন্য মাত্রায় প্রতিধ্বনিত করার পরিকল্পনা এফডিসিবির। তারা চাইছেন, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় মন্থর আর টেকসই ফ্যাশনের বার্তা এই ফ্যাশন উইকের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া।