রাজপথে ফ্যাশন প্যারেড
রাজপথে ফ্যাশন প্যারেড

চীনের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন বিপ্লব

চীনের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন আলোড়ন ফ্যাশন গ্রানিস। এঁরাই এখন কেবল চীন নয় বিশ্ব মাতাচ্ছেন। বাতিলদের তালিকায় থাকা প্রৌঢ়দের প্রেরণা এখন তাঁরা। দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সামাজিক মাধ্যম।

গেল বছরের আগস্ট মাসের মধ্যভাগ। পুরো বিশ্বের মানুষ যখন করোনাভাইরাসের প্রকোপে ঘরবন্দী, সে সময় হঠাৎ চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের ফ্যাশনপাড়া হিসেবে খ্যাত স্যানটিলান এলাকার রাস্তায় দেখা মিলল ষাটোর্ধ্ব চার বয়স্ক নারীর। পরনে ঐতিহ্যবাহী কিপাও ড্রেস, গাঢ় মেকআপ, পায়ে হাই হিল, কানে স্টেটমেন্ট এয়ার রিং পরে তাঁরা হাঁটছেন, যেন ক্যাটওয়াক করছেন। তাঁদের ১৫ সেকেন্ডের এই ভিডিও ইন্টারনেটে ঝড় তোলে, সেদিনই ভিউ হয় ৫০ লাখের বেশি। চারদিকে শোরগোল, কারা এঁরা!

জীবনকে উপভোগ করছেন, অন্যদেরও উৎসাহিত করছেন

তাঁরা হলেন ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সী একদল ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার। যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ম্যান্ডারিন ভাষায় নিজেদের পরিচয় দেন ‘দ্য ফ্যাশন গ্র্যানিস’। যদিও ‘ফ্যাশন গ্র্যান্ডমাজ’ নামেই তাঁরা পরিচিতি লাভ করে। চীন তো বটেই, এই ফ্যাশন গ্র্যান্ডমারা এখন ফ্যাশন দুনিয়ায়ও দারুণ আলোচনায়।

ফ্যাশন গ্র্যান্ডমাজের সদস্যরা মূলত কয়েকজন অ্যামেচার মডেল। ২০ বছর আগে মডেল ট্রেনিং কোর্সের সময় একে অপরের সঙ্গে পরিচয়। এরপর কেটেছে বহু বছর। তবে অবসরে যাওয়ার পর আবার এক হয়ে গড়ে তুলেছেন এই ভিন্নধর্মী গ্রুপ। ছোট ছোট ভিডিও তৈরির মাধ্যমে তাঁরা চীন, তথা বিশ্বকে দেখাতে চাইছেন ফ্যাশন উৎকর্ষের জন্য বয়স কোনো বাধা নয়।

বয়সকে হার মানানো গ্রানিরা

এসব ভিডিওতে শুধু ফ্যাশন বিষয়েই কথা হয় তা নয়, বরং সমাজের প্রবীণ নাগরিকদের নিয়ে নানা ধরনের ইতিবাচক বার্তাও দেন তাঁরা। যেমন বয়স্কদের প্রতি ভালো ব্যবহার এবং পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধেও কথা বলেন ফ্যাশন গ্র্যান্ডমাজের সদস্যরা। তবে বার্তা যে বিষয়েই হোক, ভিডিওতে তাঁদের উপস্থিতি ফ্যাশন সচেতনদের আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। আবার ফ্যাশন নিয়েও তাঁদের চিন্তা তুলে ধরেন তাঁরা। পাশাপাশি এ থেকে নিজেদের জন্য আয়ের সংস্থান করা হয়।

ফ্যাশন গ্র্যান্ডমাদের টিমের মূল সদস্য ২৩ জন। এ ছাড়া দেশজুড়ে রয়েছে তাঁদের কয়েক ডজন কন্ট্রিবিউটর। ফ্যাশন লাইভস্ট্রিমিং ও রেকর্ড করা ভিডিওতে পপ-আপ অ্যাড এবং লাইভস্ট্রিমিংয়ে প্রোডাক্ট সেলিংয়ের মাধ্যমেও তাঁরা আয় করেন। এই গ্র্যান্ডমাজদের পণ্য বিক্রির দক্ষতা নিয়ে তাঁদের এজেন্ট হি দালিংয়ের ভাষ্য হলো, ‘এই দাদিমারা ২০০ কেজি পণ্য এক মিনিটের মধ্যেই বিক্রি করতে পারেন।’ সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের ফলোয়ারের সংখ্যাও চোখ কপালে তোলার মতো। চীনের স্থানীয় ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ‘দোউয়িন’-এ তাঁদের ফলোয়ার দুই লাখের বেশি। টিকটকে নিজস্ব হ্যান্ডল ‘ফ্যাশন গ্র্যানিজ’-এর ফলোয়ার ছয় লাখের বেশি। লাইকের সংখ্যাও পেরিয়েছে ৬০ লাখের কোঠা।

সাজে ব্যস্ত যখন

গেল কয়েক বছরে চীনে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে বয়স্কদের সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। দেশটিতে অবসরে যাওয়ার সময়সীমা পুরুষদের জন্য ৬০ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৫৫। সার্বিক দিক বিবেচনায় এসব নারী-পুরুষকে নিয়ে চীন সরকার এবং সমাজব্যবস্থায় একধরনের সংকট দেখা যাচ্ছিল। ফ্যাশন গ্র্যান্ডমাজের উত্থান সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নতুন পথ দেখাবে বলে মনে করেন বেইজিং ড্রামা টেকনোলজির প্রধান নির্বাহী বাইন চ্যাং ইয়ং।

আইআই মিডিয়া রিসার্চের তথ্যমতে, চীনের বয়স্ক মানুষদের অর্থনৈতিক বাজার, তথা ‘গ্রে-হেয়ারড ইকোনমি’ এ বছর ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ইউয়েন ছুঁয়েছে। বাইন চ্যাং ইয়ংয়ের মতে, চীনের মোবাইল ইন্টারনেট ইন্ড্রাস্ট্রি বয়স্ক প্রজন্ম ছাড়া আর সব প্রজন্ম থেকেই আয় করে। ফ্যাশন গ্র্যান্ডমাজের বিপ্লবের পর এখন আর সেটাও বাদ থাকল না। কোভিডের প্রভাবে বয়স্করাও কেনাকাটা ও বিনোদনের জন্য এখন অনলাইনে ঝুঁকছেন। এই মানুষগুলোর উন্নয়নে চ্যাং ইয়ংয়ের বেইজিং ড্রামা টেকনোলজি চালু করেছে নাচ, গান, কুংফুর অনলাইন কোর্স!

রাজপথে আত্মবিশ্বাসী নানীরা

৭৬ বছর বয়সী স্যাং জিওঝু, ফ্যাশন গ্র্যান্ডমাজের একজন সদস্য। প্রায় দুই বছর হলো তিনি এই দলের অন্যতম প্রাণভোমরা। নিজেদের কাজ ও খ্যাতির বিষয়ে তিনি জানান, ‘তরুণ প্রজন্ম মনে করে তারা সব জানে, বয়স্করা কিছুই জানেন না। কিন্তু আমরাও আসলে সব জানি। বয়স্করা যেমন চান, তেমনি তাঁদের বাঁচতে দেওয়া উচিত, তাঁদের আরও বেশি আশাবাদী হওয়া উচিত।’

নাতনিদের সঙ্গে একজন গ্রানি

সর্বোপরি চীনের সমাজ, অর্থনীতি, পারিবারিক ব্যবস্থা এবং ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ফ্যাশন গ্র্যান্ডমাজ যে এক নতুন বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে, সে কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না; বরং অন্য দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য তাঁরা হতে পারেন অনুসরণীয়।
সূত্র: রয়টার্স, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।