ফ্যাশন ফটোশুটের মাধ্যমে সমাজ বদলের বার্তা দেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে নতুন ফ্যাশন ব্র্যান্ড চল। তাদের সাম্প্রতিক ফটোশুটে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
এই শুটকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণে একটা বিষয় স্পষ্ট, এখানে পোশাক মুখ্য নয়; বরং সচেতনতা সৃষ্টিই মূল লক্ষ্য। সেই সচেতনতা নারীর পক্ষে ও নারীর জন্য। পুরুষ এবং অবশ্যই চারপাশের মানুষের মনোভাব বদলানো। তাই তো এই ফ্যাশন শুটের মূল প্রতিপাদ্য: আমার পোশাক নয়, বরং আপনার দৃষ্টিভঙ্গি।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী এবং ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং বাংলাদেশে নারীরা নানাভাবে পীড়নের শিকার হয়ে থাকেন। এর আবার নানা রূপও আছে। কখনো সোচ্চার, তো কখনো নিরুচ্চার।
পথেঘাটে চলাচলে কত অস্বস্তির মুখে যে তাঁদের পড়তে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। বিশেষত পাবলিক প্লেসে একটু সেজেগুজে কেউ গেলে তাঁর দিকে তাক করে হাজারো চোখ। জ্বলতে থাকে ফ্ল্যাশ বাল্বের মতো। আর সেই নারী পড়ে যান ভয়ংকর মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে। অথচ সামান্য আন্তরিকতা, একটু মানবিক বোধে বদলে যেতে পারে ছবিটা।
বলতে গেলে এই ফটোশুটের মধ্যে দিয়ে তেমনই বার্তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে চল।
চল একটি নবীন ফ্যাশন ব্র্যান্ড; টেকসই ও নৈতিক পোশাক নিয়ে কাজ করে; সমাজ বদলের মাধ্যম হিসেবেই পোশাককে দেখছে তারা। সে জন্যই তো ফাস্ট ফ্যাশনকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি প্রকৃতিকে বাঁচাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। চল আবার পারার একটি স্বপ্ন-উদ্যোগ; পারা কাজ করে চলেছে টেকসই যাপন আর প্রকৃতিবান্ধব স্থাপত্য নিয়ে।
যা হোক, এই শুটে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারী এবং ট্রান্সজেন্ডার সদস্যের পাবলিক প্লেসে নিজের উপস্থিতিকে স্বচ্ছন্দ করতে, সবার মধ্যে সেই বোধ, সেই সচেতনতা তৈরি করতে, যাতে তাঁরা অন্যের বিরূপ এবং লোলুপ দৃষ্টির শিকার না হন, কোনো উটকো মন্তব্য ভেসে না আসে, কারও আচরণ আপত্তিকর বা অসম্মানজনক না হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের গ্রহণ করা হবে আর পাঁচজন যাত্রীর মতোই। এ জন্যই বেছে নেওয়া হয় মহাখালী বাস টার্মিনাল।
এই শুটে অংশ নিয়েছিলেন উদ্যোক্তা ডায়ানা মনিকা ম্রোং, চাকরিজীবী নন্দিনী আহমেদ, এ লেভেলের ছাত্রী মোহ হ্লা ই, আর্কিটেকচারের ছাত্রী সমৃতা চন্দ, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যার ছাত্রী তাহসিন তামান্না নদী, হাউসহেল্প শাফিয়া আকতার, অভিনয়শিল্পী, ছাত্রী ও ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মী তাসনুভা আনান এবং ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকর্মী জয়া সিকদার।
চলের সঙ্গে কাজ করতে প্রত্যেকেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ‘এ ছাড়া চলের পোশাকে থাকে কোনো না কোনো বার্তা; এই বার্তাটা যখন দূত হিসেবে আমরা পৌঁছে দিচ্ছি, তখন নিজেদের আইকন মনে হচ্ছে,’ বললেন ডায়ানা।
নিজের পড়াশোনা, নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নিয়মিত মডেলিং করে থাকেন তাসনুভা। মডেলিং নিয়ে সমাজের বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে দিতে চান তিনি। এ জন্য নিজে মডেলিং করে দেখাতে চান ট্রান্সজেন্ডার নারীরাও মডেল হতে পারেন। এভাবেই তিনি উদ্বুদ্ধ করতে চান অন্যদের। তবে নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই যেতে হয় তাঁকে, যা সব সময় প্রীতিকর নয় বলেই মন্তব্য তাসনুভার।
চল নারীর স্বয়ম্ভরতা আর এথনিসিটিকে গুরুত্ব দেয়। এ ছাড়া যে যেমন, তাকে সেভাবেই উপস্থাপন করা হয়। দুটোই বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে বলেই অভিমত মো হ্লার।
জয়া সিকদার ট্রান্সডেজন্ডার নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। তাঁর অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট। ফলে তিনি জানেন কীভাবে তাঁকে বা অন্য মেয়েদের দেখা হয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে ফটোশুট করা চ্যালেঞ্জিং। ‘কারণ এ ধরনের পরিবেশে তো আমরা নারীদের উপস্থিতি সেভাবে দেখি না। নারী কর্মীও তো নেই। বরং পুরুষদের উপস্থিতি এখানে থাকাটাই স্বাভাবিক।’ এই উদ্যোগে শামিল হয়ে অন্যদের সচেতন করতে পারবেন বলে প্রত্যয়ী তিনি।
সাফিয়া আকতারকে তো চেনাই যাচ্ছিল না। কারণ, তাঁকে আগে দেখেছি তাঁর পেশার ভূমিকায়। এ দিন তাঁকে তারকাই মনে হচ্ছিল। প্রথম দিকে একটু ভয় কাজ করলেও পরে স্বচ্ছন্দ হয়ে যান।
তবে এই শুটের পর পাবলিক প্লেসে যেতে নিজেদের মধ্যে আর কুণ্ঠা কাজ করবে না বলে জানালেন নন্দিনী।
এবার আসা যাকে আসল কথায়; অর্থাৎ পোশাক প্রসঙ্গ; যেটার কথা এতক্ষণ বলাই হয়নি। ফ্যাশন ডিজাইনার শামা কুন তাঁর নতুন সংগ্রহ তৈরি করেছেন পুনর্ব্যবহার উপযোগী কাপড় দিয়ে। এবারের সংগ্রহের পুরোটাই ব্লাউজ, জানালেন পারার একজন পরিচালক ও চল প্রকল্পের নেতৃত্বে থাকা শারারা খান। বললেন, নানা প্যাটার্নের মোট ১০টি ডিজাইনের ব্লাউজ তৈরি করা হয়েছে। দুধরনের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এসব ব্লাউজ—পুরোনো শাড়ি এবং তৈরি পোশাক কারখানার বাতিল ডেনিম। পুরোনো কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরির সময় বেঁচে যাওয়া টুকরা দিয়ে প্যাচওয়ার্ক করা হয়েছে। আর কাঁথা সেলাইয়ে করা হয়েছে জমিন অলংকরণ।
ব্লাউজ তো শাড়িরই সখা। সেভাবেই ভাবা হয়েছে; যাতে শাড়ি পরতে মেয়েরা আগ্রহী হয়। পাশাপাশি কিছু ব্লাউজ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেগুলো আবার টপ হিসেবেও পরা যাবে জিনস, স্কার্ট বা লেহেঙ্গার সঙ্গে। এই শুটে গয়না দিয়ে সহায়তা করেছে গ্লুড টুগেদার। হেয়ারস্টাইলিং ও মেকআপের দায়িত্ব পালন করেছে হেয়ারবার।
চমৎকার এই ফটোশুট দেখা ও তাদের সঙ্গে পুরো বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে করতে মনে হচ্ছিল, বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের কথা। সেই কবে তিনি যা বলে গেছেন তা বাঙালির রন্ধ্রে আজও বিদ্যমান। পরিবর্তন হয়েছে ইতরবিশেষ। নতুন দশকে এসে চল এ ধরনের উদ্যোগ দিয়ে কিছুটা হলেও যদি সমাজ বদলে ভূমিকা রাখে, তাহলেও সেটা হবে সবার জন্য বিরাট পাওয়া।
পুনশ্চ: এই ফ্যাশন ফটোশুটের ছবি নিয়ে ১২ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি চল আয়োজন করছে নিকেতনের পারা স্টুডিওতে বিশেষ ছবি প্রদর্শনীর।