শুধু বিয়ের কনের জন্যই বেনারসি, আদি এই ধারণা এখন নেই। দাওয়াতে, উৎসবে–পার্বণে, বিশেষ উপলক্ষে সোনা রঙা ভারী কারুকাজগুলো যেন ঐতিহ্যের কথাই বলে। আবার ভারী কাজের পাশাপাশি হালকা নকশার বেনারসিও এখন বেশ নজর কাড়ছে ক্রেতাদের। উৎসব পার্বণে বা বিশেষ দিনে অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম সাজেন ঐতিহ্যবাহী শাড়িতে। ছবি তোলার ফাঁকে জানিয়ে িদলেন পূজার দিনগুলোতেও এমন বেনারসি শাড়ি-গয়নায় সাজতে পছন্দ করেন তিনি।
ভারতের বেনারস শহরে উৎপত্তি বলেই শাড়িটির নাম বেনারসি। এক দেশ বেরিয়ে আরেক দেশে এলেও শাড়িটি এখন আমাদেরই হয়ে গেছে। বছরের পর বছর ধরে তাঁতিদের সুতার বুননে বদলে গেছে বেনারসির নকশা, রং, ধরন। হালকা নকশা ও হালকা ওজনের এই শাড়িগুলো কাতান হিসেবে পরিচিত।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বেনারস থেকে কিছু মুসলমান তাঁতি চলে আসেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে। কাহিনির শুরু সেই থেকেই। পরবর্তী সময়ে সরকার মিরপুরে রিফিউজি কোয়ার্টার বানিয়ে দিলে সেখানেই বসবাস শুরু করেন ওই বেনারসি কারিগরেরা। এই জায়গাটা এখন বেনারসিপল্লি হিসেবে পরিচিত। আরেকটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। চতুর্দশ শতক থেকে ভারতের বেনারসে এ শাড়ি বানানো শুরু হয়। মোগল আমলে এর বিস্তৃতি ঘটে। ভারতের অন্য কোনো শহরে এই শাড়ি তৈরি করা হয় না বলে জানান রাজধানীর মানিক বেনারসির চেয়ারম্যান সাফায়েত আলী তরফদার।
রেশম সুতার সোনালি জরি সুতার কারুকাজ। বেনারসি শাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য এটি। এই কাজ কখনো কম থাকে, কখনো বেশি। বাংলাদেশে একদম শুরু থেকে নকশাগুলো কেমন হতো? কৌতূহল মেটান সাফায়েত আলী তরফদার। গত শতকের আশির দশকে ঘরবাড়ি, টেরাকোটার নকশা করা শাড়ি ছিল জনপ্রিয়। নব্বইয়ের দশকে বেশি চলত সামার কাতান, ওয়াল কালাম, টিস্যু, সুস্মিতা কাতান, সিলসিলা কাতান। এগুলো সব ধরনের ক্রেতাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায়। ২০০০ সালের দিকে রাঙুলি, কলকা, ওয়াল কালামের মধ্যে ভিন্নতা নতুনত্ব আনে। পাড় ছাড়া, হালকা পাড়, চওড়া পাড় বেনারসি শাড়িতে সব ধরনের নকশাই হচ্ছে।
পুরো শাড়িতে কখনো খুঁজে পাবেন ছড়ানো বিভিন্ন ধরনের বুটি, জংলা লতাপাতা, বড় বড় কলকা অথবা শুধু বড় একটি ঝাড়। বেনারসির নকশায় এখন এত বেশি বৈচিত্র্য যে দেখেও যেন মন ভরে না। বেনারসি কুঠিতে একের পর এক শাড়িগুলো যখন খুলে দেখানো হচ্ছিল চোখে কিছুটা চমকই লাগে। নতুন নকশা হিসেবে পাড়ে শুধু রঙিন রং দিয়ে রাঙানো হচ্ছে। বেনারসি শাড়ির পাড়ে ভেলভেট কাপড় লাগানো হচ্ছে, স্ট্রাইপ করা মোটা পাড় দেওয়া হচ্ছে। শাড়ির জমিনে কিন্তু ঠিকই থাকছে সোনালি জরি সুতার ছোঁয়া।
নকশার আয়োজনে করা এই প্রতিবেদনে বেছে নেওয়া হয়েছে পাড় ছাড়া শাড়িতে ছড়ানো বুটির কাজ। আঁচলেও হালকা কাজ। বেনারসি কুঠির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রকিবুল হাসান বলেন, ‘প্রায় ৫০-৬০টির মতো বুটির নকশা করা হচ্ছে। হালকা নকশার এই শাড়িগুলোকে ৩০-৪০টির মতো রঙে রাঙানো যায়। দামেও কম।’ এ ধরনের বেনারসি শাড়িগুলো মূলত উপহার হিসেবে অথবা হলুদের অনুষ্ঠানে পরার জন্যই পছন্দ করা হয় বলে জানান তিনি। তবে এই শাড়িগুলো কিন্তু দাওয়াতের পোশাক হিসেবেও বেশ চমৎকার। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে সাজ ও গয়না বেছে নিতে হবে। এই বেনারসির শাড়িগুলোর মজাই হলো জমকালো দাওয়াতেও পরা যায় আবার বৈকালিক অনুষ্ঠানেও পরা যায়। হালকা হওয়ায় পরেও আরাম। সাদা, পেস্টাল, গাঢ় সব রঙেই পাওয়া যায় শাড়িগুলো। হালকা রঙের শাড়িগুলোতে যেমন স্নিগ্ধতার ছোঁয়া পাওয়া যায়, গাঢ় রঙের শাড়িগুলোয় তেমনি জমকালো ভাব ফুটে ওঠে।
হালকা নকশার এই শাড়িগুলো ১৯৯৫ সাল থেকে বাজারে আসে। প্রথম দিকে পিওর সিল্ক আর রোলেক্স জরি সুতায় কাজ করা হতো। তখন পুরোটাই হাতে বোনা হতো। ২০০০ সাল থেকে চায়না সুতা শাড়ির বুননপদ্ধতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। শাটল ও হ্যান্ডলুম এই দুই পদ্ধতির মিশ্রণে এখন শাড়িগুলো তৈরি করা হচ্ছে। সাধারণত একজন কারিগর দিনে একটি করে এই শাড়ি তৈরি করে থাকেন। সুতার কম দামের কারণেই এই শাড়ির দাম কম। এক হাজার টাকা থেকে তিন হাজার টাকায় মিরপুরের বেনারসিপল্লির যেকোনো দোকানে এই শাড়ি খুঁজে পাবেন। এই শাড়িগুলো শুধু মিরপুরেই তৈরি করা হয়। এ কারণে এটি মিরপুরের কাতান নামেও পরিচিত। বেনারসে গিয়ে মিরপুরের কাতান খুঁজলে কিন্তু পাবেন না। বেনারসির বুননে একমাত্র জ্যাকেট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বুনন পদ্ধতির নামটিই হচ্ছে বেনারসি। সম্ভবত বেনারস শহর থেকে আসার কারণেই।
বেনারসি থাকবেই
বেনারসির আবেদন ছিল, আছে, থাকবে। এমনটাই মনে করেন টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের স্বত্বাধিকারী মুনিরা ইমদাদ। পাড় ছাড়া বুটি দেওয়া বেনারসি শাড়িগুলো মানিয়ে যায় অনেক পরিবেশের সঙ্গেই। ঐতিহ্যবাহী শাড়ি হলেও আধুনিকভাবে পরা যাবে এটাকে। ব্লাউজের বিপরীতধর্মী রঙের ব্লাউজ বেছে নিতে পারবেন। হাতাকাটা, বোটনেক, হল্টারনেক যেকোনো ব্লাউজের সঙ্গেই এই শাড়ি পরা যাবে। ভারী কাজের বেনারসির সঙ্গে আবার মানানসই কাজ ও রঙের ব্লাউজ বেশি ভালো মানায়।