আভিজাত্যের দ্যুতি ছড়ানো পারস্যের ফিরোজা

মূল্যবান পাথর বসানো গয়নার জনপ্রিয়তা সব যুগে, সব কালেই ছিল। এর মধ্যে অবশ্য কিছু পাথরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চির অমলিন। তেমনই অনবদ্য ও শৈল্পিক সৃষ্টি হলো ‘পারস্যের ফিরোজা’ বা পারসিয়ান টারকোয়েজ। এ পাথর আভিজাত্যের দ্যুতিতে উজ্জ্বল।

বিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই ফ্যাশনজগতে আলাদা স্থান করে নেয় ইরানের ফিরোজা। ফিরোজা অর্থ বিজয়। ইরানের পাহলভি ভাষায় এ পাথরকে বলা হয় ‘ফিরুজে’, যার অর্থ ঔজ্জ্বল্য থেকে উদ্ভূত। রবিন পাখির ডিমের রঙের মতো হালকা সবুজাভ নীল, কখনো হালকা আকাশি, কখনো নজরকাড়া তীব্র নীল, আবার কখনো বা নীলের মধ্যে ধূসর হলুদাভ আবছায়া। নানা বর্ণের এই পাথর সুপ্রাচীন কাল থেকে গয়নাকে দিয়েছে অনন্যতা।

কিন্তু পারসিয়ান ফিরোজা বলতে পারস্যের নিশাপুর, কারমান এবং দামাভান অঞ্চলের মধ্যে ‘সি ব্লু’ বা টাটকা নীলাভ ফিরোজাই পৃথিবীব্যাপী জনপ্রিয়। ১৯৫০ দশকের শেষ থেকে ১৯৬০ দশকের গোড়ার দিকে পারসিয়ান ফিরোজার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। এমনকি আঠারো শতকে ফিরোজা বসানো কোনো অলংকার ছাড়া ইংরেজ পুরুষ বা নারীকে সুসজ্জিত বা পরিপাটি মনে করা হতো না। নিউইয়র্ক সিটির নামকরা ম্যাগাজিন টাউন অ্যান্ড কান্ট্রির প্রচ্ছদে ব্রাজিলিয়ান সমাজকর্মী ও তারকা কারম্যান মায়রিংক ভেগা তৎকালীন নারীদের ফিরোজার প্রতি ক্রেজের প্রতীক হিসেবে একজোড়া পারসিয়ান ব্লু ফিরোজা ও ডায়মন্ডখচিত কানের দুল পরে বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন।

ইরানের নিশাপুর থেকে আহরিত ফিরোজা আর হিরা দিয়ে এই মুকুটটি তৈরি করা হয়েছিল ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নের দ্বিতীয় স্ত্রী মারি লুইয়ের জন্য। এই ধরনের মুকুটকে বলা হয় ‘আধা মুকুট’

পারস্যের ফিরোজার আভিজাত্যের প্রমাণ পাওয়া যায় রাজা-রানিদের ব্যবহারে। ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথ বিয়ের উপহার হিসেবে তাঁর বাবা প্রিন্স আলবার্টের কাছ থেকে রাজকীয় গয়নার মধ্যে মূল্যবান ফিরোজা ও হীরাখচিত একটা টায়রা পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁর মেয়ে প্রিন্সেস মার্গারেটের ২১তম জন্মদিনে সেটা উপহার দেন।

ইরানি ফিরোজার জয়জয়কার ছিল বিংশ শতাব্দীজুড়ে। ইরানের পাহলভি বংশের শেষ সম্রাজ্ঞী ও সেই সময়ের ফ্যাশন আইকন ফারাহ পাহলভির প্রতিকৃতিতে ফিরোজাখচিত টায়রা শোভা পায়। তিনি বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানে প্রায়ই ফিরোজা বসানো নানা অলংকার পরতেন।

ফিরোজা বসানো এখনকার ট্রেন্ডি গয়না

সে সময় বিভিন্ন রং ও ডিজাইনের মূল্যবান ইরানি নিশাপুরি অঞ্চলে ফিরোজায় তৈরি অলংকার সুদূর ব্রিটিশ, ডাচ্, এমনকি ফরাসি রাজা-রানিরা রাজকীয় বা বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতেন। জানা যায়, প্রথম নেপোলিয়নের স্ত্রী তাঁর গয়নায় বসানো অন্য সব পাথর সরিয়ে পারসিয়ান ফিরোজা বসিয়ে নেন। পরবর্তীকালে ফিরোজা সহজলভ্য হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ট্রেন্ডের জুয়েলারির প্রতি আগ্রহ বাড়ে। আজকাল আমাদের দাদি-নানিদের গয়নার বাক্সেও প্রথমে নজর কাড়ে নীলাভ বা সবুজাভ ফিরোজার আংটি বা কানের দুল।

সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই মূল্যবান পাথরের ব্যবহার হয়ে আসছে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই। এর প্রাচীনতম ব্যবহার ছিল মেসোপোটমিয়ায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে। মিসর, চীন, পারস্যের শাসকেরা এই পাথরকে খুব মূল্যবান ও পবিত্র মনে করতেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০০ সালে ফেরাউন মিসরের সিনা মরু প্রান্তরের খনি থেকে ফিরোজা উত্তোলন করেন। দক্ষিণ-পশ্চিম আদিম আমেরিকানরা বিশ্বাস করতেন, এই পাথরের নীল রং স্বর্গ এবং সবুজ রং পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁরা মনে করতেন, এ পাথর জলকে আকর্ষণ করে বৃষ্টিদেবকে আমন্ত্রণ জানায়। তুর্কি ও পারস্যের সৈনিকেরা এ পাথরের প্রতিরক্ষামূলক শক্তিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা মনে করত, তাবিজ বা কবচ হিসেবে ফিরোজাকে যুদ্ধের ঘোড়ায় ব্যবহার করলে ঘোড়া থেকে তারা পড়ে যাবে না, যুদ্ধে আঘাত পাবে না।

ফিরোজা নিয়ে আছে নানা মিথ

এ ছাড়া ফিরোজা কুদৃষ্টি থেকে বাঁচায় বলে বিশ্বাসী আরবরা এর নাম দিয়েছে ‘হাজারো-ই-আইন’। গ্রিক ও ইংরেজরা একে প্রেমের পাথর বলে বিশ্বাস করত।
ধীরে ধীরে ফিরোজা জ্যোতিষবিদ্যায় বেশ সুপরিচিতি ও বিশ্বস্ততা লাভ করে। প্রজ্ঞা, প্রশান্তি, সুরক্ষা, সৌভাগ্য, সুস্বাস্থ্য—এসব ক্ষেত্রে রাশি অনুযায়ী অনেক আগে থেকেই ফিরোজার খ্যাতি। এ ছাড়া মুসলিম ধর্মীয় বইগুলোয় স্কলাররা এই অমূল্য পাথরের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক নিরাময়যোগ্যতার গুণগান করেছেন বলেই নারী-পুরুষ উভয়ের কাছেই এ পাথর বেশ মূল্যবান সম্পদ। বিশ্বজুড়েই এই পারসিয়ান টারকোয়েজে ভালোবাসা, আভিজাত্য ও ফ্যাশনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

কপার ফসফেট ও অ্যালুমিনিয়ামের এই স্ফটিকের রং বদলানো রূপ, আকার ও ডিজাইনের কারণে বারবার উদ্দেশ্যভেদে মানুষের প্রয়োজনে এসেছে। শত শত বছর মাটির নিচে জমে থাকা যৌগের সঙ্গে কপার, আয়রন, ফসফেস ও অ্যালুমিনিয়াম পাহাড়ের গায়ে কখনো আকাশি, কখনো সবুজ, কখনোবা নীল রঙের আবহ তৈরি করেছে। স্ফটিকে কপারের পরিমাণ বেশি হলে বেশি নীল হয়; আবার আয়রনের পরিমাণ বেশি হলে সেটা বেশি সবুজ বর্ণ ধারণ করে।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফিরোজা মেলে ইরানের নিশাপুরে

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নীল ফিরোজাগুলো তৈরি হচ্ছে পারস্যের নিশাপুরের সবচেয়ে প্রাচীন গুহা আবু ইশাকি, রুকনি, খকে কিরমিজ (রবিন পাখির ডিমের রঙের ফিরোজার জন্য বিখ্যাত), চাহ ও ক্বরে সাব্জ খনি থেকে। মাইন বা গানপাউডার দিয়ে হালকা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিরোজাসমৃদ্ধ পাথরগুলো সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর বর্ষীয়ান রত্নবিশারদদের অভিজ্ঞ চোখ টিকই খুঁজে নেয় সেরা পাথর। তারপর অলংকারশিল্পীদের দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় এই পাথরে তৈরি গয়না ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর।

গ্রীষ্মকালীন গয়নার ট্রেন্ডে ফিরোজা বসানো গয়না অন্য রকম প্রশান্তি দেয়। হাইস্ট্রিট ফ্যাশন ব্র্যান্ড জর্জেস হোবিকা তাদের গত বছরের বসন্ত সংগ্রহে ফিরোজা রংকে যেমন প্রাধান্য দিয়েছে, তেমনি তাদের স্টেটমেন্ট জুয়েলারিতে মধ্যমণি ছিল ফিরোজা বসানো কানের দুল।

মসৃণ ও নিদাগ পাথরগুলোই আজমী আর অমসৃণ, জালিকা বিশিষ্টগুলো শাজারি

দুই ধরনের ফিরোজা বেশ সমাদৃত। আজমি ও শাজারি। আজমি মসৃণ ও নিদাগ। নীল বা হালকা নীল। এ পাথরে মাকড়সার জাল বা শিরার মতো জালিকা থাকে না। শাজারি কিছুটা অমসৃণ, জালিকা বিশিষ্ট। স্পাইডার ম্যাট্রিক্সের কালো বা বাদামি দাগ এই পাথরে পাওয়া যায়।

অনেকের কাছে দাগহীন পছন্দ আবার অনেকের কাছে ম্যাট্রিক্সসহ পছন্দ। কোনটা বেশি মূল্যবান, তা নির্ভর করে পাথরের বেসিক অংশ, টেকশ্চার, রং আর পালিশের ওপর। পারসিয়ান ফিরোজা ছাড়া কিংম্যান, স্লিপিং বিউটি, বিসবি, ব্লু জেম, ব্লু রিজ, বোল্ডার টারকোয়েজ, হোয়াইট বাফেলো ইত্যাদি নানা নামের পাথর আমেরিকা, মিসর ও তুরস্কে পাওয়া যায়।

নজরকাড়া রঙের ফিরোজা বসানো গয়না ব্যবহারকারীর ইচ্ছা অনুযায়ী সোনা, রুপা বা প্লাটিনামের বেসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা যায়। ছোট ছোট ফিরোজার পাথরগুলো একসঙ্গে গেঁথে, মোজাইক বা চ্যানেল করে ব্রেসলেট, ব্রোচ, আংটি, হার, কানের দুল, পেনডেন্ট তৈরি করা হয়। হালের ফ্যাশনজগতে আবার ফিরে এসেছে সেমিপ্রেশাস এই পাথর। সাদামাটা পোশাকেও শুধু ফিরোজাখচিত গয়নাই স্টাইলিশ করে তোলে। আভিজাত্যপূর্ণ আকার, আকর্ষণীয় রং আর ঔজ্জ্বল্যের সম্মিলন ঘটে কেবল পারসিয়ান ফিরোজায়।

আভিজাত্যপূর্ণ আকার, আকর্ষণীয় রং আর ঔজ্জ্বল্যের সম্মিলন ঘটে কেবল পারসিয়ান ফিরোজায়

মূল্যবান শৌখিন জিনিস একটু বেশি যত্ন করেই ব্যবহার করতে হয়। পারসিয়ান ফিরোজার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। এটি একটি ছিদ্রযুক্ত পাথর, তাই রাসায়নিক দ্রব্য যেমন পারফিউম, সাবান, তেল, প্রসাধনসামগ্রী থেকে দূরে রাখলে আসল ফিরোজার গয়নার রং সহজে পরিবর্তন হয় না।