সন্তান পালনে বছরজুড়ে আলোচিত হয়েছে নানা বিষয়। স্কুলে নতুন ধারার পাঠ কার্যক্রম থেকে শুরু করে সন্তানদের সুস্থতা, অনেক কিছু নিয়েই ভাবতে হয়েছে অভিভাবকদের। সন্তান পালনে একসময় যেসব ধারণাকে আদর্শ মনে করা হতো, তার অনেক কিছুই এখন বাদ পড়ে যাচ্ছে। আবার নতুন বাস্তবতায় অভিভাবকদের নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। সন্তান পালনে বছরজুড়ে চর্চায় থাকা এমন কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো।
সন্তান পালন করতে গিয়ে বেশির ভাগ মা-বাবাই সন্তানকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সব ধরনের পরিস্থিতিতে তার সুরক্ষা, এমনকি সাফল্যও নিশ্চিত করতে চান। শিশু-কিশোরকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার এ মানসিকতাকেই হেলিকপ্টারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। একটি হেলিকপ্টারকে যেমন সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ করা লাগে, এ ধরনের প্যারেন্টিংও সেই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। তাই আপনার সন্তানকে যখন আপনি সর্বক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন, তখন এ অভিভাবকত্বের প্রক্রিয়াকে বলে হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং।
কয়েক বছর ধরে এই ধরনের প্যারেন্টিং নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ২০২৪ সালে সেটা যেন আরও জোরালো হয়েছে। সন্তানকে বয়স অনুসারে নিজের কাজ নিজে করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে বলছেন বিশেষজ্ঞরাও।
প্রতিটি শিশুর বিকাশের একটি পরিমাপ থাকে। আপনার শিশু বা কিশোর সন্তানটি যে বয়সে যে কাজ করতে সক্ষম, তাকে সেটি নিজ থেকে করতে দেওয়া উচিত। তবে হেলিকপ্টার প্যারেন্টস (মা–বাবা) সন্তানকে যে শুধু নিয়ন্ত্রণ করেন, তা নয়, তাদের সামনের সব পথও বাধামুক্ত রাখতে চান। এ ধরনের মা-বাবা সন্তানদের সামনের রাস্তাটি কী হওয়া উচিত, নিজেরাই তা নির্ধারণ করে সেভাবে সন্তানকে পরিচালনা করতে চান। নিজেরা সাহায্য করে হলেও এই মা-বাবারা সন্তানকে সব সময় নিখুঁত বানানোর চেষ্টায় থাকেন। অথচ একটা শিশু ছোটবেলা থেকেই ভুল করতে করতে শিখবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই মা–বাবারা সেটা মানতে চান না। শুরু থেকেই সন্তানকে সেরা বানানোর জন্য নিজেরা উঠেপড়ে লাগেন, যা সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে।
একসময় কঠোরভাবে সন্তান পালনের ধরনটিকে তুলনামূলক কার্যকর বলে বিবেচনা করা হতো। আজকাল আবার আমাদের দেশে জেলিফিশ প্যারেন্টিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে খুব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এই ধরন বেশ জনপ্রিয়। এখানে শিশু-কিশোরদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আর নিজের মতপ্রকাশের সক্ষমতা সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। সন্তানের ইচ্ছাই এখানে সব। জেলিফিশ যেমন নরম, তুলতুলে; জেলিফিশ ধরনের মা-বাবারাও তেমন। নিজেদের কোনো সিদ্ধান্ত তাঁরা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেন না। নমনীয়ভাবে তাঁরা সন্তান লালনপালন করেন। এ ধরনের অভিভাবকেরা সন্তানের জন্য কোনো নিয়মকানুন তৈরি করেন না। সন্তানের ইচ্ছার সঙ্গে তাঁরা তাল মিলিয়ে চলেন, সন্তানের নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
জেলিফিশ প্যারেন্টিং পশ্চিমা দুনিয়ায় কার্যকর হলেও আমাদের দেশের জন্য কতটুকু উপযোগী, অনেকের মনেই এ প্রশ্ন আছে। কেবল প্যারেন্টিংকে জেলিফিশ মডেলে নিয়ে গেলাম আর সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে পারলাম না, তাহলে সেটা সফল হবে না। চারপাশ সন্তানের জন্য উপযোগী করতে না পারলে জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের কার্যকারিতা কমে যাবে। তাই সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ইতিবাচক না হলে জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের উপকারিতা পাওয়া যাবে না। তখন বরং শিশুরা দ্বিধার মধ্যে পড়ে যাবে।
সন্তানদের চাওয়া থাকে তার মা-বাবা হবে ডলফিনের মতো। অনেকটা বন্ধুবৎসল। যে অভিভাবকেরা সন্তানের সঙ্গে একধরনের ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক তৈরি করেন, তাঁরাই ডলফিন প্যারেন্টস হিসেবে পরিচিত। এই ধরনের অভিভাবকেরা সন্তানের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব ঘুচিয়ে বেশ কাছাকাছি অবস্থান করতে পারেন। সময়মতো কিছুটা কড়া আবার দরকারে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো করেও মিশতে পারেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক কিশোর–তরুণকেই নানা ধরনের মিম ও ফানি ভিডিও শেয়ার করতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। এর মধ্যে মা ও বাবা–বিষয়ক ভিডিওগুলোতে তাদের চাওয়া ছিল ডলফিন প্যারেন্টস।
‘শেয়ারিং’ ও ‘প্যারেন্টিং’—এই শব্দ দুটির মিশ্রণে তৈরি হয়েছে ‘শ্যারেন্টিং’। এটি অতিরিক্ত ডিজিটাল শেয়ারিংয়েরই আরেকটি রূপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বেশির ভাগ মানুষই অতি তৎপর। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নিয়মিতই ভাগাভাগি করতে থাকেন নিজেদের ছবি, প্রতিদিনকার ঘটনাবলি। কিন্তু এটাই যখন নিজেদের ছাড়িয়ে সন্তানদের গণ্ডিতে প্রবেশ করে; সন্তানের ছবি ও দৈনন্দিন ঘটনায় ছেয়ে যায় টাইমলাইন, তখনই সেটা শ্যারেন্টিং। এই ধরনের প্রবণতা সন্তানের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
যে অভিভাবক শিশুর ছবি-ভিডিও পোস্ট করছেন, তাঁদের কাছে এটা হয়তো সাময়িক আনন্দের বিষয়। কিন্তু এভাবেই শ্যারেন্টিংয়ের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে মা-বাবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুরোটাই দখল করে নেয় সন্তানেরা। তারাই হয়ে ওঠে মূল কনটেন্ট। তাদের স্কুলজীবন, প্রতিদিনের কার্যকলাপ, মজার ঘটনা, দুঃখের ঘটনা; একে একে সবই ঠাঁই পায় ফেসবুকের পাতায়। অনেকে আবার স্মৃতি হিসেবে নিয়মিত ছবি ও গল্প শেয়ার করে রাখেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেই করে তোলেন ব্যক্তিগত ডিজিটাল আর্কাইভ।
মা–বাবার কল্যাণে সন্তানের জীবনের প্রতিটি তথ্য হয়ে যায় সবার জন্য উন্মুক্ত। ইন্টারনেটের বন্ধুরাই যখন প্রথমবারের মতো সামনে আসে, তখন মনের অজান্তেই আপনার সন্তানের একটা ইমেজ তৈরি করে তারা। সেই ইমেজ ধরে রাখতে না পেরে শিশু নিজেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এ ছাড়া প্রত্যাশার একটা আলাদা চাপ তৈরি হয় শিশুদের মনে। পাশাপাশি রয়েছে নেতিবাচক পোস্ট, যা থেকে শিশু হাজার হাজার মানুষের কাছে হাসি-ঠাট্টার পাত্র হয়ে উঠতে পারে। বেশি বেশি ছবি-ভিডিও-তথ্য শেয়ার সন্তানের গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎকে শঙ্কার মধ্যে ফেলতে পারে।