বিলেত থেকে আইন পড়ে এসে হাতে তুলে নিয়েছেন ক্যামেরা। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ছবি তোলেন। বেশ কিছু ছবি নিয়ে প্রদর্শনীও করেছেন গত বছর। কেন শুধুই ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের ছবিই তোলেন তিনি? ফারহানা সেতুর কাছে সেই গল্প শুনেছেন কবীর হোসাইন
‘এই মাছগুলান আমার পোলার আছিল, পোলাডারে আল্লাহ নিয়ে গেল, এই মাছগুলানরে আমার বাঁচায় রাখতে হবে যেমনেই হোক।’ রাকিবের আব্বার এই কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে। রাকিব আর আমাদের মাঝে নেই এখন।
রাকিবকে পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। ফোন নষ্ট হয়ে গেছে বলে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না। কাঁদছিল। পাশে ওর মা। উদ্ভ্রান্ত, অসহায় চোখে এদিক–ওদিক তাকাচ্ছিলেন। আমার ফোনটা ওর মাকে দিলাম। ফেরার সময় একটা নম্বরও দিয়ে এলাম, প্রয়োজনে যাতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এরপর যখনই ওরা চিকিৎসা নিতে ঢাকায় আসত, আমাকে জানাত। গিয়ে দেখা করে আসতাম। ফোনেও কথা হতো। একবার ঢাকায় থাকার জায়গা পেল না, আমার বাসায় নিয়ে এলাম। তখন একা থাকি। ওরা আমার ওখানে থেকে চিকিৎসা নিয়ে গ্রামে চলে গেল। কিছুদিন পর খবর পেলাম, মারা গেছে রাকিব। কতই–বা বয়স, ছয় কি সাত বছর! লিউকেমিয়া হয়েছিল। ওর মৃত্যুর খবরে আমার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল।
রক্তের ক্যানসার লিউকেমিয়া: রক্তে তিন ধরনের কণিকা থাকে—লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা। অস্থিমজ্জার ভেতর এই রক্তকণিকাগুলো তৈরি হয়। লিউকেমিয়া হলো রক্ত বা অস্থিমজ্জার ভেতর শ্বেত রক্তকণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। যেকোনো বয়সের মানুষের লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমা হতে পারে। লিউকেমিয়াকে আমরা ব্লাড ক্যানসার বলে থাকি।
গল্পটা আমার
এমন অনেক রাকিবের সঙ্গেই এখন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে আমার জীবন। আমি এ রকমটাই চেয়েছিলাম কি না, সেই প্রসঙ্গ আজকাল অবান্তর মনে হয়। তবে হ্যাঁ, গোটা একটা জীবন আমি কেবল ছবিই তুলতে চেয়েছি। আর চেয়েছিলাম চিত্রশিল্পী হতে। এখানেই বিপত্তি। আমাকে একটি লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিল আমার পরিবার—ব্যারিস্টার হতে হবে। নিজের অনিচ্ছায় যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক শেষ করে যখন ইন্টার্নশিপ করছি, বুঝতে পারছিলাম, ক্রমেই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। তবে এসবের মধ্যে কিন্তু ছবি তোলা থেমে থাকেনি। মন খারাপ হলেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। ইতিমধ্যে পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট থেকে বেসিক এবং ফাউন্ডেশন কোর্স করে ভর্তি হয়ে গেলাম তিন বছর মেয়াদি প্রফেশনাল ডিপ্লোমায়। তখনই চূড়ান্ত আপত্তিটা এল পরিবার থেকে। এবার আর আপস করিনি। বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। সঙ্গে আমার ক্যামেরা আর পোষা বিড়াল। এসে উঠলাম এক বন্ধুর বাসার গ্যারেজের পাশে ছোট্ট ঘরে। সেখান থেকে সাত মাস পরে মিরপুরে ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিলাম। বাসাভাড়া দিতে পারতাম না সময়মতো। সে এক ভয়ানক জীবন। ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়া নেই। ক্লাস শেষ করে পান্থপথ থেকে হেঁটে বাসায় যাই। সংগ্রাম করছি, তবে এর মধ্য দিয়ে আমি আমাকে খুঁজে পেতে শুরু করলাম।
হারিয়ে যাওয়া মুখ
প্রায়ই তখন মনটা বড় বিষণ্ন হয়ে থাকত। বেশি মন খারাপ হলে চলে যেতাম বিএসএমএমইউ। আগেও যেতাম। কিন্তু তখন যাওয়া–আসাটা প্রায় নিয়মিত হয়ে গেল। রোগাক্রান্ত মানুষদের দেখতাম। তাদের সঙ্গে কথা বলতাম। গ্রাম থেকে আসা অধিকাংশ মানুষই চিকিৎসার অনেক কিছু বুঝত না। কোন চিকিৎসক দেখাবে, কোথায় পরীক্ষা করাতে হবে, কোথা থেকে রিপোর্ট নিতে হবে—বুঝতে পারত না। আমি পাশে থেকে সাহায্য করতাম।
২০০৯ সালে ৫ বছর বয়সী আমার এক খালাতো বোন লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। ওর চিকিৎসার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ওর সঙ্গে থাকতাম। তখন থেকেই রোগাক্রান্ত শিশুদের প্রতি মায়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ২০১৬ থেকে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ছবি তুলছি। প্রতিবার লেন্সে চোখ রাখতেই অদ্ভুত বিষণ্নতা ঘিরে ধরে। কিছুদিন পরই হয়তো শুনব, শিশুটি আর নেই! ফাতেমার কথা মনে পড়ছে। অন্য একটা কাজে ওর অঞ্চলে গিয়েছিলাম। মনে হলো, এসেছি যখন, একবার দেখা করে যাই। গিয়ে দেখি ওর একটা ছোট্ট ভাই হয়েছে। ফাতেমাকে সঙ্গে নিয়ে বাচ্চাটাকে সাজালাম। ফাতেমা প্রবল উৎসাহ নিয়ে সাজিয়ে দিল। ছবিগুলো প্রিন্ট করে পাঠিয়ে দেব বলে ফিরে এলাম। সপ্তাহখানেক পরে খবর পেলাম, ফাতেমা মারা গেছে। আহা, ছবিগুলো দেখেও যেতে পারল না! জানালার পাশে বসে স্কুলের দিকে তাকিয়ে থাকত ও। ভালো হলেই স্কুলে যাবে, আমাকে বলেছিল। আমি স্কুলপানে তাকিয়ে থাকা ফাতেমার ছবি তুলেছিলাম।
অঙ্কুরে ঝরে না পড়ুক
লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শতাধিক শিশুর ছবি তুলেছি এখন পর্যন্ত। মাত্র তিনজন শিশু বেঁচে আছে। অথচ এদের অধিকাংশই বেঁচে থাকতে পারত। যথাযথ চিকিৎসা পেলে অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মাহিন বেঁচে আছে। বেঁচে আছে ফয়সাল। গত বছর নভেম্বরে বনানীর এশিয়াটিক সেন্টারে ‘অঙ্কুর’ শিরোনামে আমার একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল। সেখানে ছবিগুলোর গল্প শুনে একজন হৃদয়বান ব্যক্তি ওদের চিকিৎসার জন্য দেড় লাখ করে টাকা দিয়েছেন। দেশ–বিদেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি আমার ছবি কিনেছেন। প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৬০ শতাংশ আমি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য দিয়েছি। কতটা কী পেরে উঠছি, জানি না। কেবল জানি, এই শিশুগুলো আমারই সন্তান, আমাদেরই সন্তান। আমি একটা মাধ্যমমাত্র। ছবির মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষের কাছে ওদের অসহায়ত্বের বার্তাটা পৌঁছে দিতে চাইছি। চাইছি, আর একটি শিশুও এই রোগের কারণে অচিকিৎসায় ঝরে না যাক। রঙিন হয়ে উঠুক আমার সাদা-কালো ছবিগুলো।