আজ বন্ধু দিবস। আমাদের দেশে দিবসটি পালিত হয় আগস্টের প্রথম রোববার। বন্ধুত্ব উদ্যাপনের জন্যই তো এই দিন। তবে এ বছর পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ, অনেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে না। এমনকি ক্যাম্পাস যখন খুলবে, তখনো কারও কারও সঙ্গে দেখা হবে না আর। সাম্প্রতিক সহিংসতায় যাঁরা কাছের বন্ধুকে হারিয়েছেন, পড়ুন তাঁদের মধ্যে একজনের লেখা। বন্ধু জাহিদুজ্জামান তানভীনকে নিয়ে লিখেছেন মো. মুস্তাকীম আবতাহী। দুজনই ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পড়েছেন
সাউথ হল অব রেসিডেন্সের ১১৯ নম্বর রুমের সি বেডে থাকত জাহিদুজ্জামান তানভীন। যন্ত্রকৌশল ’১৭-র সেরা ছাত্র। আমাদের বন্ধু। এই রুমে থাকতাম আমি, মিতিন, নেহাল, শাতিল আর তানভীন। হ্যাঁ, চারজনের রুমে আমরা পাঁচজন থাকতাম।
আমার আর তানভীনের বিছানা ছিল পাশাপাশি। মাথার ওপর একটিই ফ্যান, সেটারই বাতাস ভাগাভাগি করে নিতাম দুজন। এই ফ্যান ছাড়া নিয়ে ওর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি লাগত। আমরা গাজীপুরের গরমে মরতাম, আর তানভীন ফ্যান অফ করে চাদর গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকত। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে একটা হুংকার দিত, এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলত, ‘ক্লাসে যাবি?’ উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে ক্লাসে যেতাম। ‘না’ হলে দুজনই আবার ঘুম দিতাম।
সকালে আমার সেট করা অ্যালার্মে আমার ঘুম না ভাঙলেও তানভীনেরটা ভেঙে যেত। এরপরে এসে শুরু করত ধাক্কাধাক্কি। একটা কথা খুব মনে পড়ে, মেকানিকস অব ম্যাটেরিয়ালস পরীক্ষা, অনেক কঠিন। তানভীন দেখি পড়া বাদ দিয়ে শুধু ঘুমায়। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘পড়বি না?’ আমাকে বলে, ‘তুই এত পড়ে যা পাবি, আমি না পড়লে হয়তো একটু কমই পাব। তাই কষ্ট করছি না।’ এবং হয়েছিলও তা-ই!
আমরা অনেকেই অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম, শেষ পর্যন্ত সেটা আর বাস্তবায়ন করা হয়ে উঠত না। কিন্তু তানভীন যেটা চিন্তা করত, করে দেখাত। আমরা হয়তো ভাবতাম, টিউশনি করে টাকা জমিয়ে একটা ভালো ফোন কিনব। তানভীনের ভাবনা আলাদা। একবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটা রোবোরেস কম্পিটিশন জিতে এল। আমরা সবাই বললাম, ‘ট্রিট দে!’ কিন্তু সে ওই টাকার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে একটা রেডিও ওয়েভ কন্ট্রোলার কিনে ফেলল। কারণ, থেমে থাকা যাবে না। এরপর বোট বানানো, বিদেশ থেকে ডিফারেন্সিয়াল আনিয়ে রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি বানানো। জল-স্থল-আকাশ, সব দিকেই ছিল তানভীনের আগ্রহ।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) প্রতিটি শিক্ষাবর্ষ শেষে দুই মাসের ছুটি থাকে। আমরা সবাই বছর শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। কারণ, ছুটি কাটাতে বাসায় যাব। তানভীন ওই সময়ে হলে বসে থেকেই ড্রোন বানানোর কাজ করত। আমরা যখন মেকানিকসের পড়া পড়তাম, তানভীনের টেবিলে তখন ফ্লুয়িড মেকানিকসের বই। আগ্রহের বিষয়গুলোর পেছনে এত বেশি সময় দিত, খুব অবাক হতাম।
তানভীনের গল্প আসলে বলে শেষ করার নয়। কোনো কিছুতেই ‘না’ নেই। আইইউটিতে ক্রিকেটে লং অনের সেরা ফিল্ডার, ফুটবলে লেফট ব্যাকের ভরসা, ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন। মার্শাল আর্টে ব্রাউন বেল্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়ররা অনেকেই ক্লাস বাদ দিয়ে তানভীনের সঙ্গে কাজ করতে চলে আসত। কারণ, সবার চোখেই তানভীন সেরা। ছোট-বড় সবার মনেই দাগ কেটে যেত। বেলা দুইটা হোক, কিংবা রাত দুইটা; আর কাউকে না পাওয়া গেলেও প্রয়োজনে তানভীনকে পাওয়া যেত ঠিকই। অথচ সেই ছেলেটার জানাজায়ও আমরা কেউ থাকতে পারলাম না। ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়।
কথা ছিল, বর্ষায় পানি বাড়লে হাওর দেখতে যাব। এই তো, এ বছর গ্রীষ্মেই ঠিক করেছিলাম। কথা ছিল, আমার বিয়েতে আর কেউ না নাচুক, তানভীন নাচবে। কথা ছিল, কোনো একদিন নেপাল ঘুরতে যাব আমরা। কথা ছিল, এবার ভ্যালোর্যান্টে আমাকে ক্যারি দিয়ে ও গোল্ডে ওঠাবে। হলো না, কোনোটাই হলো না।
তানভীনরে, সবচেয়ে বড় আফসোস, শেষবারের মতো তোকে দেখতেও পারি নাই। সে জন্যই মনে হয় এখনো বিশ্বাস হয় না যে তুই নাই। মনে হয় কয় দিন পরই তো আবার দেখা হবে। তোর যে চোখ খুলে ঘুমানোর অভ্যাস, এখন সেই চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। যেভাবে কাঁথায় মাথা মুড়ে ঘুমাইতি সব সময়, ওভাবেই সাদা কাপড়ে ঢেকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে তোকে। কীভাবে মেনে নিই, বল!