বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ বিজ্ঞান জার্নালগুলোর একটি নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্ট। সেই জার্নালে প্রধান সহরচয়িতা (শেয়ার্ড-ফার্স্ট-অথর) হিসেবে বাংলাদেশি আরিফুল হকের একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এই স্নাতক। এখানেই থেমে থাকেননি। গত মাসে জার্মানির ফ্রেডরিক আলেক্সান্ডার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন এই গবেষক। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাসপাতাল, ইউনিভার্সিটি হসপিটাল আরল্যাঙ্গানে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। সেখানেই পোস্টডক্টরাল হিসেবে যোগ দিয়েছেন এ মাসে। বার্লিনের শ্যারিতে ইউনিভার্সিটি হসপিটালের হয়ে কাজ করছেন এখন।
এত সব শুনে মনে হতে পারে, শিক্ষাজীবনের গোড়া থেকেই নিশ্চয় বেশ পড়ুয়া ছিলেন আরিফুল, নিশ্চিত মেধাবী হিসেবে তাঁর নামডাক ছিল। আদতে তা নয়। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল, ছেলে চিকিৎসক হবে, কিন্তু মেডিকেলে পড়া তো দূরের কথা, ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগই পাননি আরিফুল। তাঁর আগ্রহের জায়গা ছিল পদার্থবিজ্ঞান। শেষ পর্যন্ত মা-বাবার ইচ্ছাতে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হন।
ফার্মেসিতেও দ্বিতীয় বর্ষ অবধি সিজিপিএ একেবারেই ভালো ছিল না। ছেলের পড়ালেখার এমনই করুণ দশা ছিল যে বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাবাকে ডেকে যখন বলা হলো, ‘আপনার ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার’, তখন আরিফুলের টনক নড়ে।
সে সময় তাঁকে সাহস জুগিয়েছিলেন বন্ধু সিনথিয়া ফারিন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই কখনো বিজ্ঞানমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ হাতছাড়া করেননি আরিফুল। চাকরি খোঁজার চিরাচরিত ভাবনা থেকে বেরিয়ে গবেষণায় মন দিয়ে আরও বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখান সিনথিয়া। এমন কাউকে খুঁজে বের করার পরামর্শ দেন এ ক্ষেত্রে যিনি আরিফুলকে পথ দেখাতে পারেন।
সে মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানের দ্বারস্থ হন আরিফুল। কিন্তু তাঁর অধীন কাজ করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীর তালিকাটা বেশ লম্বা। তাঁর গবেষণাগারে ঢুকে কেবল কাজ দেখার সুযোগ পাওয়াটাও তখন আরিফুলের মতো ‘সাধারণ’ শিক্ষার্থীর জন্য বিরাট ব্যাপার। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফুল সেই অনুমতিটুকু পেয়েই মন দিয়ে দেখতে শুরু করলেন, অগ্রজেরা সেখানে কীভাবে কাজ করেন। তাঁদের কাজ শেষে পড়ে থাকা বিকার ধোয়াধুয়ির কাজও করতেন আরিফুল। দিনের পর দিন গবেষণাগারে এমনভাবে সময় দিতে দেখে শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিজের তত্ত্বাবধানে নেন অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান।
পরের অংশে যাওয়ার আগে জানিয়ে রাখি, বন্ধু সিনথিয়া ফারিনই কিন্তু এখন আরিফুলের স্ত্রী। আর তাঁর মায়ের নাম গুলশান আরা ও বাবা এমদাদুল হক।
নিউরোসায়েন্স গবেষক মাহবুবুর রহমান হয়ে উঠলেন আরিফুলের পথপ্রদর্শক। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের এই ছাত্রকে তিনি নিয়মিত জার্নাল পড়তে দেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কাজের ধরন সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেন। অন্যান্য গবেষণায় যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি আরিফুল নিজেই তৈরি করেন ‘অটিজম মডেল’। এটি মূলত গবেষণাগারে ইঁদুরের মধ্যে অটিজমের বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার মডেল। অধ্যাপকদের সঙ্গে বিভিন্ন গবেষণার কাজে যুক্ত থেকে সরকারি অনুদানও পেয়েছেন আরিফুল। গবেষণামূলক নানা কাজের মধ্যে আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় একটির কথা, ২০২০ সালে নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্টে যেটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গবেষণায় স্ট্রোকের পর মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু কোষকে সক্রিয় করে তোলা এবং মৃতপ্রায় কোষগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ইঁদুরের ‘মডেল’ দিয়ে পাওয়া গিয়েছে সাফল্য। অর্থাৎ স্ট্রোকের পরেও স্ট্রোকজনিত ক্ষতি কমানো সম্ভব হয়েছিল ইঁদুরে।
উচ্চশিক্ষার জন্য ২০১৯ সালে জার্মানির লুবেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ডাক পান আরিফুল হক। তবে পুরোনো একাডেমিক ফলের কারণে শেষ পর্যন্ত সে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশ্য পরের বছর নেচার সায়েন্টিফিক রিপোর্টে গবেষণা প্রকাশের পরই চিত্রটা বদলে যায়। একই সঙ্গে তাঁকে ডক্টরেট করার সুযোগ দেয় জার্মানির দুই বিশ্ববিদ্যালয়: ফ্রেডরিক আলেক্সান্ডার ও ফ্রাইবুর্গ। ফ্রেডরিক আলেক্সান্ডার বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেছে নেন আরিফুল।
আরিফুলের কথায় বারবারই উঠে আসছিল মাহবুবুর রহমানের নাম। ছাত্রকে নিয়ে নর্থ সাউথের এই শিক্ষক কী বলছেন? ‘আরিফুল দারুণ মেধাবী, ভীষণ পরিশ্রমী একজন শিক্ষার্থী। সময়বাধা কাজ শেষ করতেও বেশ পারদর্শী। গবেষণার ক্ষেত্রে তার ভাবনায় নতুনত্ব আছে,’ বলছিলেন অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। আরও যোগ করলেন, ‘বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ফার্মেসির ছাত্র হয়েও আরিফুল ইলেকট্রনিকসের কাজে বেশ পারদর্শী। সীমিত অর্থায়নের গবেষণায় এমন দক্ষতা দারুণ কাজে আসে। অটিজম মডেল নিয়ে কাজ করার সময় পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকায় প্রাণীদের আচরণ নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি কেনা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। সে নিজেই কাস্টোমাইজ করে কম খরচে এমন একটি বিকল্প যন্ত্র তৈরি করে, যা দিয়ে কাজটি সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়েছিল। সে আমার জীবনের অন্যতম সেরা শিক্ষার্থী।’
জার্মানি গিয়ে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নিয়ে কাজ করেছেন আরিফুল। এই বিষয়ে গবেষণা করেই অর্জন করেছেন ডক্টরেট। সেটিও মাত্র তিন বছরে, ‘ম্যাগনা কাম লড’ সম্মানের সঙ্গে, যার শাব্দিক অর্থ ‘অত্যন্ত প্রশংসার সঙ্গে’। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই ডক্টরেট ডিগ্রি পেতে সময় লাগে আরও বেশি। জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে আসার রহস্য জানতে চাইলে আরিফুল বলেন, ‘প্রত্যেকের জীবনের গল্পই আলাদা। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ আপনাকে বুঝবে না, এটাই স্বাভাবিক। খুব অল্প কিছু মানুষই শেষ পর্যন্ত আপনার ওপর বিশ্বাস রাখবে। কাছের মানুষগুলোকে ভালো রাখার ইচ্ছা আমার সব সময়ই ছিল। আর ছিল নিজের ওপর কখনো বিশ্বাস না হারানোর প্রতিজ্ঞা।’
আরিফুল দারুণ একটা অনুদানও পেয়েছেন জার্মানিতে কাজ করে। পোস্টডক্টরাল হিসেবে যে গবেষণা এখন করছেন, সেটিও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা–সংক্রান্ত। ক্যানসার ও রিউমাটয়েড আর্থরাইটিসের রোগীদের শরীরে ম্যাক্রোফেজ আর টি লিম্ফোসাইটের মিথস্ক্রিয়া বিষয়ে গবেষণা করবেন আরিফুল। এর জন্য মানবদেহের কোষের বিপাকক্রিয়া নির্ণয় করবেন তিনি। আর যে পদ্ধতিতে এই বিপাকক্রিয়া নির্ণয় হবে, তা ‘পেটেন্ট’ করার আবেদনও করবেন বলে জানালেন। মা-বাবার স্বপ্নপূরণ করে চিকিৎসক হতে পারেননি। কিন্তু চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার কাজেই দারুণ সাফল্য পেয়েছেন এই তরুণ।