প্যারিস অলিম্পিকে আবার নিজের ডানা মেললেন যুক্তরাষ্ট্রের জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস
প্যারিস অলিম্পিকে আবার নিজের ডানা মেললেন যুক্তরাষ্ট্রের জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস

মাঠের বাইরে যে লড়াই করে অলিম্পিকে ফিরলেন বাইলস

২০১৬ সাল। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে বসেছে অলিম্পিক। যুক্তরাষ্ট্রের নারী জিমন্যাস্ট দলে আলাদা করে নজর কাড়লেন ১৯ বছরের এক তরুণী। সদা হাস্যোজ্জ্বল, চঞ্চল মেয়েটাকে দেখলে যে কারও মন ভালো হতে বাধ্য। যুক্তরাষ্ট্র দলের সর্বকনিষ্ঠ জিমন্যাস্ট, আশার পারদও তাই কম। কিন্তু মাঠে দেখা গেল অন্য এক দৃশ্য। একের পর এক রুটিন করে চমকে দিচ্ছেন দর্শক। রিও অলিম্পিক শেষে যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন তাঁর গলায় পাঁচটি পদক—চারটি সোনা আর একটি ব্রোঞ্জ!

রিও অলিম্পিকের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে উঠলেন সিমোন বাইলস। পত্রিকার প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বিলবোর্ড, ছাদ খোলা গাড়িতে সংবর্ধনা। কেউ কেউ এমন দাবিও করলেন, মাইকেল ফেল্‌পসের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অলিম্পিয়ান বাইলস। চারদিকে এত চাকচিক্য, এত খ্যাতি—সব মিলিয়ে যেন অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন বাইলস। তাই তো অলিম্পিকের পর জিমন্যাস্টিক থেকে দূরে রইলেন পুরো একটা বছর। এই সময় টিভি পর্দা আর রিয়েলিটি ড্যান্স শোতে তাঁকে দেখা গেছে বেশি । কারও কারও মনে সন্দেহ হয়েছিল, খ্যাতির পাকে না হারিয়ে যান বাইলস। তবে এক বছরের ব্যবধানে যখন ফিরলেন, পুরোনো সেই বাইলসেরই দেখা মিলল। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ—পোডিয়ামে বাইলসের জন্য একটা জায়গা যেন বরাদ্দই থাকত। জিমন্যাস্টিক বিশ্বে বাইলস তত দিনে অনন্য এক নাম। ১৯ বছর বয়সে রিওতে যা করেছেন, ২৩ বছর বয়সে টোকিওতে সেটাকেও ছাড়িয়ে যাবেন, এমনটাই ছিল সবার ভাবনা। সে ভাবনায় পানি ঢেলে দিল কোভিড-১৯। করোনার প্রভাবে পিছিয়ে গেল টোকিও অলিম্পিক। পুরো এক বছরের জন্য থেমে গেল সব প্রতিযোগিতা।

এক বছর পর টোকিওতে যখন অলিম্পিকের আসর বসল, তত দিনে বদলে গেছে সব সমীকরণ। অলিম্পিকের আসর যেন ধূ-ধূ মরুচর। খেলোয়াড়েরা আসেন, কোচরা আসেন, অনুশীলন হয়; অতঃপর অলিম্পিক ভিলেজে ফেরত যাওয়া। নেই কোনো আনন্দ, নেই দর্শকদের উচ্ছ্বাস, নেই সতীর্থদের সঙ্গে খুনসুটি। শুধু অনুশীলন আর দফায় দফায় করোনা টেস্ট। সদা হাস্যোজ্জ্বল বাইলস জাপানে প্রবেশ করেই ম্লান হয়ে যান। একে তো প্রত্যাশার বিশাল চাপ, অন্যদিকে পরিবার-পরিজন ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মঞ্চে প্রতিযোগিতা। স্বভাবতই পারফরম্যান্সে পড়ল এর প্রভাব। অনুশীলনে নিজের স্বাভাবিক রুটিনগুলোও শেষ করতে পারছিলেন না। একবারও ঠিকঠাক ল্যান্ডিং করতে পারছিলেন না। কোচও বুঝতে পারছিলেন সমস্যা আছে। তবু মনের জোর নিয়ে নেমেছিলেন সিমোন।

আবারও নিজের জাদু দেখালেন বাইলস

কোচের আশঙ্কা সত্যি হলো। দলগত ইভেন্টে ল্যান্ডিং হলো না ঠিকঠাক, শূন্যে আড়াইবার ঘোরার বদলে ঘুরতে পারলেন মাত্র দেড়বার। বুঝতে পারলেন, তাঁকে দিয়ে আর হচ্ছে না। মুহূর্তেই এরিনা ত্যাগ করলেন, ফিরে এসে জানালেন, তিনি আর খেলছেন না। কোচ থেকে সতীর্থ, বাইলসের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেন সবাই। অলিম্পিক থেকে সরে দাঁড়ালেন বাইলস। তার আগেই ব্যালান্স বিমে জিতেছেন ব্রোঞ্জ আর দলগত ইভেন্টে রৌপ্য। বাইলসের সমস্যা যতটা না শারীরিক, তার থেকে বেশি ছিল মানসিক। জিমন্যাস্টিকের ভাষায় একে বলা হয় ‘টুইস্টিস’। এতে জিমন্যাস্টরা নিজেদের অবস্থান ঠিকভাবে বুঝতে পারেন না। যে কারণে শূন্যে ভেসে থাকা অবস্থায় পারফর্ম করতে পারেন না, ল্যান্ডিং ঠিকমতো হয় না। এককথায় বলা যায়, মাথার সঙ্গে শরীরের যোগাযোগে সামঞ্জস্য থাকে না। সাধারণত এমন অবস্থায় কোচরা খেলা বন্ধ করে দেন। কারণ, একটি ভুল ল্যান্ডিং মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে।

বিশ্বের সেরা জিমন্যাস্ট মাসের ব্যবধানে হয়ে উঠলেন ভিলেন। জিমন্যাস্টিকে পদক হাতছাড়া হওয়ার ক্ষোভ বাইলসের ওপর ঝেড়েছেন সবাই। বাইলস বলেন, ‘যেখানেই গিয়েছি, মনে হয়েছে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করছে। কিছু না বললেও মনে হচ্ছিল তারা বলছে।’ লাগাতার সমালোচনার মুখে খেলাধুলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন।

সিমোনের পথচলার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তাঁর নানি। খেলার মাঠে নানিকে দেখলেই উজ্জীবিত হন সিমোন

এই পুরোটা সময় সিমোনের ঢাল ছিল তাঁর পরিবার। ছোটবেলাতেই বিচ্ছেদের কারণে তাঁর জায়গা হয় ফস্টার কেয়ারে। সেখান থেকে তাঁকে দত্তক নেন নানা-নানি রন বাইলস ও নেলি বাইলস। এর পর থেকে সিমোন বাইলসের মা বলি আর নানি, দুই–ই ছিলেন নেলি বাইলস। সিমোনের পথচলার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণাও তিনি। ছোটবেলা থেকে শুরু করে অলিম্পিক, যেখানেই লড়েছেন সিমোন, ছায়াসঙ্গী হয়ে তার পাশে ছিলেন নানি। ছিলেন না শুধু একটা জায়গাতেই, টোকিও। তাই নাম প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সবার আগে তাঁকেই জানিয়েছিলেন। নেলি তাই আফসোস করে বলেন, ‘ওই একবারই আমরা ওর সঙ্গে ছিলাম না। থাকলে বোধ হয় এমন হতো না।’ প্রতিবার খেলতে নামার আগে নানির কাছ থেকে চুল বেঁধে মাঠে নামেন বাইলস, সেটাই হয়তো সবচেয়ে বেশি পোড়াচ্ছিল তাঁকে।

সিমোন বাইলসের সোনার হাসি

এক বছরের বিরতি শেষে ছোট ছোট করে শুরু হলো ফিরে আসার লড়াই। নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ে যেতেন, জিমে ঘাম ঝরাতেন, নতুন জিমন্যাস্টদের মতো শুরু করতেন। নেতিবাচক কোনো কথা যাতে শুনতে না হয়, তাই বন্ধ করে দিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বাদ দিলেন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা। মন ভালো রাখতে পরিবারকে সময় দিতে শুরু করলেন। লক্ষ্য একটাই, ২০২৪ অলিম্পিকে নিজেকে প্রমাণ করা।

সবচেয়ে বড় বাধা ছিল বয়স। সবার কানাঘুষা, ২০২৪ সালে তাঁর বয়স দাঁড়াবে ২৭। যুক্তরাস্ট্রের অলিম্পিক দলে জায়গা পেতে হলে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও তিনি ফুরিয়ে যাননি। চ্যালেঞ্জটা নিলেন। ধীরে ধীরে নিজেকে শক্ত করলেন, প্রমাণ করা শুরু করলেন। নতুন শুরুটা অ্যান্টওয়ার্পে ২০২৩ বিশ্ব জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে। ঠিক এই মঞ্চেই ১০ বছর আগে প্রথম নজর কেড়েছিলেন তিনি। এবার সেখানে জিতে নিলেন ৪টি স্বর্ণ, একটি রৌপ্য। অলিম্পিকের জন্য ট্রায়ালে গেলেন নিজেকে শতভাগ ফিট করার জন্য। অবশেষে প্যারিসে ফিরলেন নিজেকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে।

প্যারিসে মুক্ত বিহঙ্গের মতো প্যারালাল বারের এ–প্রান্ত থেকে ও–প্রান্ত উড়ে বেড়িয়েছেন। এ যেন ২০১৬ অলিম্পিকের বাইলস, ২৭ বছর বয়সে এসেও সেই একই উদ্যম। প্যারিস থেকে বাড়ি ফিরছেন চার পদক নিয়ে, তিনটি স্বর্ণ আর একটি রৌপ্য। বাইলসের গলার কাছে একটি ট্যাটু রয়েছে। সেখানে লেখা, ‘অ্যান্ড আই স্টিল রাইজ়।’ সিমোন বাইলস এখনো উড়ছেন। নিজের অবসাদকে পেছনে ফেলে, জেদ, পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে বাইলস এখন সর্বকালের অন্যতম সেরা জিমন্যাস্ট।