তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে স্নাতক পড়তে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের শাকিল রেজা। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর জটিল এক রোগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালে কাটল মাসের পর মাস, প্রাণে বাঁচলেও হারালেন চলনশক্তি। তাহলে কি এভাবেই হারিয়ে যাবেন শাকিল? তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শোনাচ্ছেন রাজিউল ইসলাম
দিনাজপুর জিলা স্কুলের প্রধান ফটক দিয়ে হুইলচেয়ারে করে মাঠে প্রবেশ করতেই শাকিল রেজার দিকে এগিয়ে এলেন কয়েকজন শিক্ষক। কিছু সময় পরে একজন-দুজন করে অনেক শিক্ষার্থীই তাঁকে ঘিরে ধরল। সবার অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো শাকিল তাদের অনেক দিনের পরিচিত। অথচ জিলা স্কুল থেকে প্রায় এক দশক আগে মাধ্যমিক শেষ করেছেন শাকিল। সেই হিসাবে কয়েকজন শিক্ষক, অফিস সহকারী আর পিয়ন ছাড়া অন্য কারও তাঁকে চেনার কথা নয়। খুদে শিক্ষার্থীদের আচরণে কিন্তু সে রকম মনে হচ্ছিল না, শাকিলের সঙ্গে নানা বিষয়ে এমন অন্তরঙ্গভাবে কথা বলছিল তারা, যেন কত দিনের চেনা।
স্কুল মাঠে অনেকের ভিড়ে শাকিলের সঙ্গে সেদিন আর কথা বলার সুযোগ হলো না। কথা হলো পরদিন রাত নয়টায়, দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়িতে তাঁর নানার বাসায়। এক ফাঁকে জানতে চাই, এত দিন আগে স্কুল ছেড়ে গেছেন, তারপরও নতুন শিক্ষার্থীরা আপনাকে কীভাবে চেনে?
শাকিল বলেন, ‘স্যারেরা আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। স্কুলজীবনে বিতর্ক, উপস্থাপনা, আবৃত্তি, বক্তৃতা, গল্প বলা, গান গেয়ে নানা পুরস্কার পেয়েছি। স্কুল ও কলেজে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ’ প্রতিযোগিতায় জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছি। এমন নানা বিষয়ে উদাহরণ দিতে গিয়ে স্যারেরা আমার প্রসঙ্গ আনেন। হয়তো তাঁদের মুখেই ওরা আমার গল্প শুনেছে। ফেসবুকেও কেউ কেউ আমাকে চেনে।’
দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকার সেন্ট যোসেফ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন শাকিল। উচ্চমাধ্যমিক করে বৃত্তি নিয়ে চলে যান তুরস্কে। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের বিষয় ছিল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা। পড়াশোনা শেষ করে সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন ইস্তাম্বুল গেদিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ শিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্রে, পরিচালক পদে। ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগে দেড় মাসের ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। সেদিন শাকিলের সঙ্গে আলাপের মধ্যেই বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। সেই বৃষ্টি যেন শাকিলের রোগজয়ের গল্পকে আরও বেদনাবিধুর করে তুলল।
২০১৮ সালের শেষ দিকে তুরস্কে যান শাকিল রেজা। সরকারি ব্যবস্থায় ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ‘চালায়ান’ নামের এলাকার এক ডরমিটরিতে থাকেন। ১০ মাস তুর্কি ভাষার একটা কোর্স করার পর শুরু হয় আসল পড়াশোনা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বন্ধুবান্ধব। সুযোগ হলেই বেরিয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ অনুষদের রেডিওর দুটি অনুষ্ঠানও পরিচালনা করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এমন সব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার স্বপ্ন নিয়েই তো এসেছেন তিনি।
২০২০ সালের জুলাই। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির প্রকোপ। ঘরবন্দী দিন কাটছে। একদিন হঠাৎ করেই পিঠে মেরুদণ্ডের একটু ওপরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন শাকিল রেজা। অসহনীয় ব্যথা। অর্থোপেডিকের শরণাপন্ন হতে হলো। ডাক্তার শাকিলের ব্যথাস্থান নেড়েচেড়ে দেখে একটু চিন্তিতই হয়ে পড়লেন। নানা পরীক্ষার পর চিকিৎসক ধারণা করলেন শাকিলের ফুসফুস ক্যানসার হয়েছে। নিউক্লিয়ার পিইটি টেস্টের পর ধারণা আরও পোক্ত হলো। কিন্তু বায়োপসিতে ক্যানসারের কোনো আলামত পাওয়া গেল না। আবার বায়োপসি করতে বলা হলো। এবার সার্জারির মাধ্যমে ফুসফুসের কাছ থেকে নমুনা নেওয়া হলো। দীর্ঘ পরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা বুঝলেন ক্যানসার নয়, শাকিলের হয়েছে যক্ষ্মা।
যক্ষ্মা তখন বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। ফুসফুসের ডান পাশ থেকে শুরু হয়ে পুরো মেরুদণ্ডে ছড়িয়ে গেছে। যক্ষ্মার ওষুধের ছয় মাসের ডোজ তৎক্ষণাৎ শুরু করে দেওয়া হলো। ছয় মাসের জায়গায় অবশ্য এক বছর ওষুধ সেবন করতে হলো।
হাড় আগেই ভাঙা শুরু হয়েছিল। বায়োপসিসহ নানা পরীক্ষায় দীর্ঘ সময় গেছে। লম্বা সময় চিকিৎসা শুরু না হওয়ায় ভাঙা হাড় আরও ভেঙে গেল। ওষুধে ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। ডাক্তাররা ভাবলেন সার্জারির মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে আসতে হবে।
তাই ওষুধের ডোজ শেষ হওয়ার পর শাকিলকে ইস্তাম্বুলের সরকারি বাশাকশেহিম ছাম ভে সাকুরা শেহির হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। এই হাসপাতালেই একে একে তাঁর তিনটি সার্জারি হলো। মেরুদণ্ডে যে হাড়গুলো ভেঙে গিয়েছিল, সেগুলো সরিয়ে ১৪টি ধাতব পাত বসিয়ে দেওয়া হলো। এরপর নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হলো বেশ কিছুদিন।
সার্জারির আগে থেকেই মেরুদণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত স্নায়ুর প্রভাবে নিম্নাঙ্গের অনুভূতি একটু একটু করে হারাতে শুরু করেছিলেন শাকিল। সার্জারির পর সেই অনুভূতি একদম চলে গেল। চলনশক্তিহীন হয়ে পড়লেন শাকিল। হাসপাতালে শুরু হলো একঘেয়ে জীবন। লেখাজোখা শুরু করলেন শাকিল। করোনা আর নিজের জীবন ওলটপালট করে দেওয়া আকস্মিক ঝড়ের গল্প লিখতে থাকলেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা লিখলেন। ২০২১ সালে সেসব লেখা নিয়েই প্রকাশ হলো অশ্রুত একুশ নামে শাকিলের প্রথম বই।
শাকিলকে একজন তত্ত্বাবধায়ক দেখভাল করতেন। তাঁর সহায়তা নিয়েই প্রয়োজনীয় কাজ করতে হতো। অন্যের ওপর নির্ভর হয়ে থাকতে ভালো লাগত না। ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শে প্রয়োজনীয় ব্যায়াম চালিয়ে যেতে থাকলেন। দুই মাস পর হুইলচেয়ারে বসার শক্তি ফিরে পেলেন শাকিল। বলছিলেন, ‘হাসপাতাল আমার একদম ভালো লাগত না। অন্য রোগীদের দেখে আরও বেশি ক্লান্ত আর অসহায় হয়ে পড়তাম। কিন্তু চিকিৎসকেরা ছাড়তেও চাইতেন না।’
তত দিনে হাসপাতালে কেটে গেছে আট মাস। একদিন তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে খুব ঝগড়া হলো। ভাবলেন, আর না, কারও ওপর নির্ভরশীল হয়ে আর হাসপাতালে থাকব না। ডাক্তাররা নিষেধ করলেন। কিন্তু শাকিল নাছোড়, চলে গেলেন নিজের বাসায়।
বাসায় নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন শাকিল। অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা, বন্ধুদের সঙ্গে অনলাইনে আড্ডা, পড়াশোনা এসবই নিয়ে কাটতে থাকল দিন। ২০২২ সালে সরাসরি ক্লাস শুরু হলে সশরীর ক্যাম্পাসে হাজির হলেন। বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে মনে হলো না কঠিন একটা সময় পার করে এসেছেন। এই বন্ধুদের সঙ্গেই ২০২৩ সালে ওড়ালেন সমাবর্তন-ক্যাপ।
শাকিল বলেন, ‘যখন বেঁচে ফিরলাম, নিজেকে মনে হচ্ছিল অর্ধমানব। স্বাভাবিকভাবেই জীবনটা আমার জন্য কঠিন। চাইলেই সবকিছুকে আগের ছন্দে বাঁধতে পারি না। জীবনকে তাই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করছি। প্রত্যেকটা জীবনই ভিন্ন ও সুন্দর। আমার জীবনের সেই সুন্দর দিকটাই আমি খোঁজার চেষ্টা করছি।’
এই মানসিক শক্তিই শাকিলের শক্তি। ইস্তাম্বুলে যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, সেই হাসপাতালে এখনো নিয়মিত যান তিনি। চলনশক্তিহীন মানুষদের নিজের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলেন। কীভাবে ফিজিওথেরাপি নিয়ে বল ফিরে পেয়েছেন, সেসব অভিজ্ঞতা শোনান। জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে চান শাকিল।