আলসারের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ডায়াবেটিক রোগীদের পা দেখে জুতা তৈরির ব্যবস্থাপত্র দেন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি সায়েদ আহমেদ। পায়ের স্বাস্থ্যের এ বিষয় নিয়েই পিএইচডি করেছেন। ড. সায়েদের পেডোরথিস্ট বা পদস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার গল্প শুনেছেন কাউসার খান ও সজীব মিয়া
গায়ে গাউন, মাথায় ক্যাপ, মুখে মৃদু হাসি। সমাবর্তন মঞ্চে সনদ গ্রহণ করছেন এক বাংলাদেশি। এমন একটি ছবির পাশে বড় করে লেখা, ‘ড. সায়েদ আহমেদ, ফার্স্ট পিএইচডি ইন পেডোরথিকস ইন অস্ট্রেলিয়া’, অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ায় সায়েদই প্রথম পেডোরথিকস বা পদস্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি অর্জনকারী। পেডোরথিক অ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়ার ওয়েবসাইটে ছবিটির নিচে সায়েদের পরিচিতিমূলক তথ্যও আছে। ১১ সেপ্টেম্বর সেই ছবি নিয়েই তাঁর সঙ্গে আলাপ শুরু করি। সায়েদ আহমেদ বললেন, ‘আমার পিএইচডি শেষ হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। আর ছবিটা গত ২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন ক্রস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে আমার হাতে সনদটি তুলে দেওয়া হয়।’
১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পেডোরথিক অ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়ায় সদস্য আছেন হাজারের মতো। সায়েদ আহমেদের অর্জনে পেশাদার পেডোরথিস্টদের এই সংগঠনের গর্বের শেষ নেই। তাঁর পিএইচডির বিষয় সম্পর্কে সংগঠনটি বলেছে, ‘ফুটওয়্যার অ্যান্ড ইনসোল প্রেসক্রিপশন ফর পিপল উইথ ডায়াবেটিস অ্যান্ড নিউরোপ্যাথি হু আর অ্যাট হাই রিস্ক অব প্লান্টার ফরফুট আলসারেশন।’
চিকিৎসাসংক্রান্ত খটমট বিষয়টিই আমাদের সহজ করে ব্যাখ্যা করেন সায়েদ আহমেদ, ডায়াবেটিক রোগীদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম বলে সহজেই জীবাণুর সংক্রমণ হয়। ফলে তাঁদের পা খুবই নাজুক অবস্থায় থাকে এবং একবার আলসার সংক্রমণ হলে সারে না। অনেকের পা কেটে ফেলতে হয়। পা নিরাপদ রাখতে পারলে আলসার প্রতিরোধ করা যায়। তাই ফুট আলসার প্রতিরোধে জুতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক মাপের জুতার জন্য সায়েদ আহমেদ রোগী দেখার সময় জেনে নেন রোগীর বয়স ও ওজন, পায়ের কোন সমস্যায় ভুগছেন, জুতা পরে কী কাজ করবেন, পায়ে রক্তসঞ্চালন পরিস্থিতি, কোন পরিবেশে থাকেন ইত্যাদি। তারপরই রোগীর পায়ের জন্য নকশা করেন জুতা।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সিডনিতে থাকেন সায়েদ আহমেদ। সেখানে গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশেও বিস্তৃত হয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কাজ।
কীভাবে এই পেশায় এলেন, শুনতে চাই সেই গল্প।
ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সায়েদ আহমেদ। সেবার মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাননি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কলেজ অব লেদার টেকনোলজিতে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি) ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান। তাঁর এক মামার পরামর্শে ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বেছে নেন সায়েদ।
মাদারীপুরের কালকিনিতে সায়েদ আহমেদদের বাড়ি। তাঁর বাবা ছিলেন স্থানীয় আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা আন্ডারচর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। জুতা, চামড়াশিল্প নিয়ে পড়াশোনা করেছেন শুনে গ্রামের লোকজন বলাবলি শুরু করেন, ‘হেডমাস্টারের ছেলে চামার হবে!’ এ কথা শুনে খুব মন খারাপ হয় সায়েদের।
২০০০ সালের কথা সেটা। ফুটওয়্যার বিভাগটি সেবারই চালু হয়েছে। প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী সায়েদ। নতুন বিভাগ, শিক্ষকের স্বল্পতা আছে, ল্যাবও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। শুরুতেই হতাশ হয়ে পড়েন। এমন সময় তাঁদের বিভাগে যোগ দেন তাজুল ইসলাম। এই শিক্ষকের সান্নিধ্যেই জুতা নিয়ে সায়েদ আহমেদের স্বপ্ন দেখা শুরু, ‘স্যার ছিলেন ভীষণ পরিশ্রমী। আমাদের ব্যাপক উৎসাহ দিতেন। দিনভর স্যারকে ল্যাবে পড়ে থাকতে দেখতাম। একসময় আমারও ঠিকানা হয়ে যায় ল্যাব। চামড়া, জুতা—এসবই তখন ধ্যানজ্ঞান। চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত আমি ৬৫ জোড়া জুতা বানিয়েছি।’
স্নাতক শেষে ব্যবসার পরিকল্পনা করছিলেন সায়েদ আহমেদ। তবে সেই পরিকল্পনা শুরুতেই ভেস্তে যায়। হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আড়াই হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে আট কোটি টাকার প্রতিষ্ঠান কিনতে গিয়েছিলাম! পরে জানতে পারি, যিনি বিক্রি করছেন, তিনি একজন প্রতারক!’ স্বভাবতই সে যাত্রায় আর ব্যবসায় হাতেখড়ি হলো না। ২০০৬ সালে যোগ দিলেন বাটায়। জ্যেষ্ঠ উৎপাদন কর্মকর্তা হিসেবে শুধু জুতা উৎপাদনের হিসাব রাখলেই তো হয় না, মানুষের মনস্তত্ত্বও বুঝতে হয়। অফিস থেকে মাঝেমধ্যেই সায়েদকে বিভিন্ন এলাকা সফরে পাঠানো হতো। বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে দেখতেন, কোন কোন জুতা বেশি বিক্রি হয়। সায়েদ তখন অবাক হয়ে লক্ষ করতেন, যেসব জুতা তাঁরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে বানিয়েছেন, নকশাও সুন্দর, সেগুলোই হয়তো পছন্দ করছে না গ্রাহক। মানুষ হয়তো বেছে নিচ্ছে সাধারণ কোনো মডেলের জুতা।
সায়েদ আহমেদ বলছিলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক জরিপেও দেখা যেত, আমাদের কিছু জুতা দেখতে তেমন সুন্দর নয় কিন্তু বিক্রি হচ্ছে বেশি। ক্রেতারা বারবার ওই ধরনের জুতাই কিনছে বেশি। তখন আমরা কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, সুন্দর জুতাগুলোর সামনের অংশ সরু, বিদেশি মডেল ব্যবহার করে তৈরি। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের পায়ের সামনের অংশ বেশি চওড়া, গোড়ালির অংশ সরু। তাই দেখতে অতটা ভালো না হলেও আরামের জন্য সামনের দিকে খোলা জুতাই মানুষ বেশি কিনছিল।’
সায়েদ আহমেদ তাঁর এক শিক্ষকের গবেষণাপত্রেও এর আগে পায়ের যত্নে সঠিক জুতার গুরুত্বের বিষয়টি নিয়ে পড়েছেন। এ দুই মিলিয়ে তাঁর কাছে মনে হলো, জুতার ব্যাপারে নিজের অজ্ঞতা দূর করতে আরও পড়াশোনা করা দরকার। সেই পড়াশোনায় একসময় এসে যোগ হলো ডায়াবেটিক রোগীদের উপযোগী জুতার বিষয়টি।
চাকরির ফাঁকে ফাঁকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর করেন সায়েদ আহমেদ। ব্যবসায় প্রশাসনে সনদ নিলেও তাঁর ধ্যানজ্ঞান তখন জুতা। তত দিনে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছেন, জুতা নিয়ে উচ্চশিক্ষা নেবেন। বিভিন্ন দেশে খোঁজখবরও করছিলেন। বিশ্বের খ্যাতনামা ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের কারও কারও সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগও করেন। এমনই একজনের নাম কার্ল হেইঞ্জ স্কট। জার্মান এই পেডোরথিস্ট থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। তাঁকেই ‘গুরু’ মানলেন সায়েদ। গুরুর পরামর্শেই ২০০৯ সালে ঢাকার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান।
সিডনিতে এক বন্ধুর বাসায় উঠেই চাকরির খোঁজ শুরু করেন সায়েদ। তিন দিনের মাথায় স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে ফুটওয়্যার ডিজাইনার হিসেবে চাকরি পান। কিন্তু সায়েদের লক্ষ্য তো পড়াশোনা। মাস কয়েকের মধ্যে সেটাও শুরু করেন। অস্ট্রেলিয়ান স্কুল অব পেডোরথিকসে পেশাগত কোর্সে ভর্তি হন। এ সময় একজন পেডোরথিস্টের সঙ্গে পরিচয়। ৭০ বছর বয়সী মানুষটার সান্নিধ্যে এসে নতুন নতুন অনেক কিছু শিখতে থাকেন। সায়েদ বলছিলেন, ‘ছেলের সঙ্গে রাগারাগি করে ভদ্রলোক একা থাকতেন। আমি তাঁর বাসায় গিয়ে মেঝেও মুছে দিতাম। তিনি আমাকে তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ অনেক কিছুই শেখান।’
গুরুমুখী বিদ্যা। তাই পূর্ণকালীন চাকরি করতে পারতেন না। আবার খণ্ডকালীন চাকরি করে নিজের খরচও চালাতে পারছিলেন না। এ জন্য রাতে পিৎজা ডেলিভারি শুরু করেন সায়েদ। এত কষ্ট করেও পড়াশোনার ক্ষতি হতে দেননি। বরং তিন বছরের পেশাগত কোর্স শেষ করেছেন দেড় বছরে। ২০১১ সালে প্রো-লার্ন পেডোরথিকস স্কুল ইন ওকলাহোমা থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পদস্বাস্থ্যসেবা প্রদানের অনুমোদন পান। অস্ট্রেলিয়ার একটি নামজাদা জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকীয় কাজে যোগ দেন। চাকরির পাশাপাশি পেডোরথিস্ট হিসেবে পড়াশোনাও চালিয়ে যান। ২০১৫ সালে পেডোরথিস্ট হিসেবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সনদ অর্জন করেন। এরপর চাকরি ছেড়ে রোগী দেখা শুরু করেন সায়েদ। রোজকার এসব ব্যস্ততার মধ্যেই ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন ক্রস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন, যা শেষ হয় গত বছর।
গবেষণার পাশাপাশি পায়ের যত্নে ‘ফুট ব্যালান্স টেকনোলজি’ ও ‘অর্থোজেনিক্স’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন সায়েদ আহমেদ। প্রতিষ্ঠান দুটির প্রধান নির্বাহীও (সিইও) তিনি। সিডনির পাশাপাশি ঢাকায়ও স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তিসেবা দিচ্ছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে ডায়াবেটিক রোগীর পাশাপাশি অন্যদের পায়ের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বিশেষ জুতা নির্ধারণ ও বিপণনসেবা দেন সায়েদ। এ জন্য সাভারে কারখানাও গড়ে তুলেছেন। সায়েদ আহমেদ বলছিলেন, ‘মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে কারও পা যেন বাধা না হয়, এই সংকল্প নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।’