‘ডিজিটাল শিক্ষা দিবস’ আমাদের যা মনে করিয়ে দেয়

আজ ডিজিটাল শিক্ষা দিবস উপলক্ষে লিখেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) জি এম রাকিবুল ইসলাম

শিক্ষার্থীরা এখন পড়ালেখায় প্রযুক্তির ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ঢাকার ড্যাফোডিল কলেজে ছবি তুলেছেন সাবিনা ইয়াসমিন

যেকোনো দিবস উদ্‌যাপনের একটা সাধারণ উদ্দেশ্য হলো বিষয়টার গুরুত্ব অনুধাবন করে বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং করণীয় নির্ধারণ। সেই লক্ষ্যেই শিক্ষায় প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার পালিত হয় ‘ডিজিটাল শিক্ষা দিবস’। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা অ্যালায়েন্স ফর এক্সেলেন্ট এডুকেশন দিবসটি ঘোষণা করে। ভবিষ্যৎ শিক্ষার স্বরূপ নির্ধারণে প্রযুক্তির যুগান্তকারী ভূমিকাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে দিবসটি উদ্‌যাপিত হয়। এই দিনে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি একীভূত ও কার্যকর শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হয়েছে, তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এত সব অগ্রগতি সত্ত্বেও ডিজিটাল বিভাজনের কারণে অনেকেই যে পিছিয়ে পড়ছে, সেই বাস্তবতার ওপরও দিনটি আলোকপাত করে।

যেখানে বাংলাদেশের প্রতি দুজনে একজন মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি, সেখানে ডিজিটাল শিক্ষার সম্ভাবনা বিরাট। তবে আশাজাগানিয়া পরিসংখ্যানের ভিড়ে দেশের একটা বিরাটসংখ্যক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সমাজের দরিদ্র জনগণ এবং দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের অনেকেই ডিজিটাল শিক্ষার এই সব উপায় এবং উপকরণ ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ডিজিটাল শিক্ষা দিবস এই বৈষম্য নিরসন করার কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়। যদিও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি ও অপ্রতিরোধ্য বিস্তার নতুন নতুন শিক্ষার সুযোগ এনে দিচ্ছে, একই সঙ্গে এটা বিভাজনও তৈরি করছে। আজকের ডিজিটালাইজড বিশ্বে অনেক শিক্ষার্থীরই নিজস্ব ডিভাইস কিংবা নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ না থাকার কারণে নানা ধরনের শিক্ষার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত রয়ে যাচ্ছে। এই বৈষম্য সমাজে বিদ্যমান অসমতাকে বাড়িয়ে তুলছে এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে থাকা জনগণের শিক্ষার সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাপ্রযুক্তির ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছে সরকার। সাউথ ইস্ট ব্যাংক গ্রীন স্কুলে ছবি তুলেছেন সাবিনা ইয়াসমিন

২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বর্তমান সরকার। সব সেবা খাতের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকেও ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ তারা চলমান রেখেছে। ‘ব্লেন্ডেড এডুকেশন মাস্টারপ্ল্যান’ প্রণয়ন ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ। ১০ বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনাকে বলা যায় শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারবিষয়ক মহাপরিকল্পনা। স্কুলে স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, শেখ রাসেল আইসিটি ল্যাবরেটরি, শিক্ষকদের আইসিটি প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল কনটেন্ট রিপোজিটরি গঠন, শিক্ষক বাতায়ন নামের প্ল্যাটফর্ম তৈরি, শিক্ষার্থীদের জন্য লার্নিং নেটওয়ার্ক কানেক্ট, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম মুক্তপাঠের মতো উদ্যোগের সুবাদে করোনাকালেও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ সরকার। তবে ডিজিটাল বিভাজনের কারণে সব শিশু শিক্ষার এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি।

বাংলাদেশে ডিজিটাল শিক্ষার রূপান্তরকারী সম্ভাবনাকে সত্যিকার অর্থে কাজে লাগাতে হলে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং একীভূত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এটা করার জন্য দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা। কেবল নিজস্ব ডিভাইস (যেমন মোবাইল বা কম্পিউটার) কিংবা ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করলেই হবে না; বরং ডিজিটাল সাক্ষরতা, ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার, ব্যয় নির্বাহের সক্ষমতা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য সরকারি সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতের সহযোগিতামূলক উদ্যোগ অপরিহার্য।

এটা বোঝাটা খুব জরুরি যে শিক্ষায় প্রযুক্তির সংযোজন কেবল ডিভাইস সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সুচিন্তিত বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে সার্বক্ষণিক পরিবীক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চলমান রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিখন-শেখানো কার্যক্রমে প্রযুক্তিকে আরও সফলভাবে ব্যবহারের জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং প্রশিক্ষণ দরকার, যেন প্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্ন না ঘটিয়ে বরং উপকার করে।

২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় যেখানে সবাইকে নিয়ে একটি টেকসই বিশ্ব গঠনে সারা বিশ্ব একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, সেখানে এটাও সমানভাবে সত্যি যে বিশ্বের সব দেশ কিংবা একটা দেশের সর্বস্তরের মানুষ উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় সমানতালে এগোতে পারছে না, পিছিয়ে পড়ছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে ডিজিটাল শিক্ষা যেমন অপরিহার্য, তেমনি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে প্রবেশগম্যতার অভাবে অনেকের শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তৈরি হয়েছে শিখন ঘাটতি। তাই আজকের এই দিনে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে চলুন আমরা ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে এনে সব শিক্ষার্থীর জন্য মানসম্মত শিক্ষার ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করি। আমরা আমাদের দেশের তরুণদের পূর্ণ সম্ভাবনার বিকাশ এবং তাদের জন্য সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্যে এমন শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করি, যেখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সর্বজনীন মানসম্মত শিক্ষায় সমান সুযোগ পেয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হবে।