জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় একটি খাবারের দোকানে কাজ করতেন হাবিবুর রহমান। দিন দিন হয়ে ওঠেন সবার ‘হাবিব ভাই’। এক দশক আগে হারানো চাকরি আবার ফিরে পেয়ে ক্যাম্পাস ছাড়লেন তিনি। হাবিবের ১০ বছরের ক্যাম্পাসজীবনের গল্প শুনেছেন তানভীর রহমান
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে একটা লেদার কারখানায় কাজ করতাম। সেখানে জুতা, ব্যাগ, জ্যাকেট তৈরি হতো। সেই চাকরিটা হঠাৎ চলে যায়। ২০১৪ সালের দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। তখন আমার বয়স ২৬ কি ২৭ বছর। আমার স্ত্রীর ভাইয়েরা এখানে চাকরি করেন। স্ত্রীও তাঁদের সঙ্গে থাকত। সেই সূত্রে ঘুরতে এসেছিলাম। ছয় মাসের বেশি কোনো কাজ নেই, বেকার। খুব হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। সে সময় ক্যাম্পাসের বটতলায় ‘খালার দোকান’ নামে একটা খাবারের দোকান ছিল। সেই খালা একদিন ডেকে বললেন, ‘এভাবে আর কয়দিন বেকার থাকবা! আমার এইখানে কাজ করতে থাকো। যাই কামাও, মোটামুটি সংসারটা চলে যাবে।’
তাঁর কথামতো কাজ শুরু করলাম। বাবুর্চির কাজ। এই কাজ খুব একটা ভালো লাগত না। পরে নূরজাহান হোটেলে মেসিয়ারের কাজ শুরু করি। দৈনিক ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করে বেতন পেতাম ৬০০-৭০০ টাকা। সবচেয়ে বেশি কাজ আমাকেই করতে হতো। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের খাওয়াতে আমার ভালোই লাগত। এ কারণে হোটেল পরিবর্তন করলেও কাজ পরিবর্তন করি নাই। সর্বশেষ রাঁধুনি নামের এক হোটেলে কাজ করতাম।
হোটেলে কয়েক সারিতে বসার ব্যবস্থা থাকে। আমি যে সারিতে খাবার দিতাম, সেই সারিতে শিক্ষার্থীরা বেশি বসত। এমনও হতো, নিজের সিরিয়ালে খাবার দিয়ে আরেক সিরিয়ালে খাবার দিতে হয়েছে। আমার কাছে শিক্ষার্থীরা আসত, কারণ আমি সবার সঙ্গে সত্যি কথাটা বলতাম। যদি জানতাম, খাবারটা ভালো না বা টেস্ট হয় নাই, মজা হবে না, আগে থেকে বলে দিতাম। তখন তারা বলত, আচ্ছা, আপনার কাছে যে খাবারটা ভালো মনে হচ্ছে, ওইটা দেন। তারা আমার ওপর ভরসা রাখত।
ক্যাম্পাসে নানা সংগঠনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের অনেকের সঙ্গে চিনপরিচয় হয়। নিয়মিত রক্ত দিতাম। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কারও আত্মীয়স্বজনের রক্তের দরকার হলেও দিয়ে আসতাম। এ কারণে সবাই আমাকে ভালোবাসত। করোনার সময় হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাই। প্রায় ১৯ মাস দোকান বন্ধ ছিল, কোনো কাজ ছিল না। অনেকে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছে। আমাকে এসবের মধ্যে পড়তে হয়নি। ৩৮ আবর্তনের সেতু ভাই, যিনি ব্যাংকে চাকরি করেন, প্রতি মাসের শুরুতে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছেন। করোনার পুরো ১৯ মাসই তিনি আমাকে সহযোগিতা করেছেন।
জাহাঙ্গীরনগরের যেকোনো হলেই আমি ঢুকতে পারতাম। কেউ আটকাত না। অথচ এক হলের স্টাফ অন্য হলে গেলে পরিচয় দিতে হয়। আমার বেলায় এই নিয়ম খাটত না। সবার একটা বিশ্বাস ছিল, আমি কারও কোনো ক্ষতি করব না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের ভিসি, নুরুল আলম স্যারও আমাকে পছন্দ করতেন। আমি একটা খাবার হোটেলের কর্মচারী, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তবু কয়েকবার বটতলায় পরিদর্শনে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেক শিক্ষকের সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক ছিল।
আমি কোটাপদ্ধতি আগে থেকেই অপছন্দ করতাম। আমাদের বাড়ি গাজীপুর। একবার সেখানকার শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল হাসপাতালে ওয়ার্ডবয় পদে চাকরির আবেদন করি। সেখানে প্রতি ওয়ার্ডে তিনজন করে লোক নেবে। সব যোগ্যতা থাকার পরও কোটার কারণে আমার চাকরি হয়নি। তাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রদের পাশে ছিলাম। আবার ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা আমার আত্মীয়স্বজন, ভাই-বন্ধুর চেয়ে অনেক বেশি। তাদের প্রতি ভালোবাসা থেকেও সঙ্গে ছিলাম। ১৬ জুলাই যখন ভিসির বাসভবনের মধ্যে ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করা হয়, তখন আমি বটতলায় দাঁড়িয়ে। আমার চোখের সামনেই সবকিছু হয়েছে। বহিরাগতরা পিকআপ ভরে ভরে ক্যাম্পাসে আসছে। এরপর হল থেকে সব শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসে। আমিও বাসা থেকে ক্যাম্পাসে চলে আসি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভোর চারটা পর্যন্ত ক্যাম্পাস পাহারা দিই। পরদিন বহিরাগতরা পাঁচ গাড়ি ভর্তি হয়ে মেইন রোডে আসে।
আমি তখন কাজে ব্যস্ত। চিন্তা করলাম, আমরা তাদের (শিক্ষার্থীদের) খাওয়াচ্ছি। তাদের ভালো-মন্দ দেখতেছি। কোন জায়গার কোন বহিরাগতরা এসে মেরে চলে যাবে, আর আমরা কিছুই করব না! আমরাও তো ক্যাম্পাসের অংশ। তাদের প্রতি অধিকার আছে। আমার সামনে আমার এক ভাইকে মারবে আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব, এটা হতে পারে না। এই চিন্তা করে ওই দিন আর কাজ করলাম না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেইন রোডে চলে গেলাম। আন্দোলনের সময় আমার গায়ে চার-পাঁচটা ছররা গুলি লাগে। এর মধ্যে কয়েকটা স্প্লিন্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল থেকে বের করেছি। বাকিগুলো বেশ ভেতরে থাকায় বের করা যায়নি।
লেদার কারখানায় চাকরি হারানোর পরও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। তারাই কিছুদিন আগে জানায়, আমি যেন আবার জয়েন করি। তাই ১৬ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে আসি। ছাত্রদের ক্যাম্পাসজীবন হয় পাঁচ বছরের, আমার ১০! ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার সময় ৪৯ আবর্তনের সাবাব ভাই গাড়িতে ওঠার আগপর্যন্ত সঙ্গে থেকেছেন। আমাকে ব্যাগে হাত লাগাতে দেননি, গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছেন। ৪৭ আবর্তনের স্বর্ণা আপু, স্বামীর সঙ্গে ক্যাম্পাসের পাশে ইসলামপুরে থাকেন। আমি চলে যাব শুনে স্বামীসহ এসে পাক্কা এক-দেড় ঘণ্টা থেকেছেন। ৫১ আবর্তনের এক ভাই আজ ফোন করে খোঁজ নিল। এসব মনে পড়লে মনটা ভার হয়ে আসে, ব্যথা লাগে।