প্রয়াত শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের দর্শন ও মূলবোধকে ধারণ করে দুই দশকেই দেশের অন্যতম রিয়েল এস্টেট কোম্পানি হয়ে উঠেছে আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক, তৈরি করেছে নিজস্ব সিগনেচার। জল-হাওয়ার সর্বোচ্চ ব্যবহারের পাশাপাশি তাদের প্রকল্পগুলো সবুজেরও অপূর্ব নির্দশন। আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেইন খালেদ–এর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলাপচারিতায় বসেছিলেন মুনির হাসান
সপ্তাহান্তে দিলকুশা-মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা নির্জনই থাকে। কাজেই সময়মতোই ২৭ দিলকুশার বায়তুল হোসেন বিল্ডিংয়ে পৌঁছে যাই। এই ভবনেই আনোয়ার গ্রুপের সদর দপ্তর। গ্রুপের ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের করপোরেট সদর দপ্তর এই ১৬ তলা ভবনে।
আনোয়ার গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেইন খালেদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি আমরা। কথা ছিল, তাঁর সঙ্গে দুপুরে খাব। ভবনের ১৬ তলাতেই সবার খাওয়ার ব্যবস্থা। সেখানেই হোসেইন খালেদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেলাম। খেতে খেতে গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান হোসেন মেহমুদ ও নির্বাহী পরিচালক হোসেন আক্তারের সঙ্গে ও
আলাপ হলো।
পরে ১৩ তলায় আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের অফিসে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষে শুরু হলো আমাদের আলাপচারিতা। রুম থেকে আকাশটা দেখা যায়, বাইরে বারান্দার মতো একটা জায়গায় বেশ কিছু গাছপালাও আছে। হোসেইন খালেদ জানালেন, এই ভবনের প্রায় সব ফ্লোরেই তাঁদের বাবা প্রয়াত শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের জন্য একটা কক্ষ বরাদ্দ ছিল। তিনি বলতেন, যে কক্ষে দিনের ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা থাকতে হবে, সেখান থেকে যেন আকাশ দেখা যায় আর যেন থাকে সবুজের ছোঁয়া।
হোসেইন খালেদের কাছ থেকে জানা গেল, আনোয়ার হোসেন ট্রেডিং দিয়ে ব্যবসার সূচনা করলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে কারখানা খোলার দিকে তাঁর নজর থাকত। হোক সেটা কাপড়, ইস্পাত, কেব্ল, নির্মাণসামগ্রী বা ভৌত অবকাঠামো। ‘কিছু একটা বানিয়ে খুব তৃপ্তি পেতেন বাবা। চিন্তা, কাঁচামাল জোগাড় থেকে শেষ পর্যন্ত ফাইনাল প্রোডাক্টটা যখন দেখতেন, তখন তাঁর মধ্যে একটা তৃপ্তি কাজ করত। নিজে অনেক কিছু ইমপ্রোভাইজেশনের কাজও করতেন। আবার কাস্টমারের মুখে যখন সন্তুষ্টির ছায়া দেখতেন, তখনো তৃপ্তি পেতেন। বানানোতেই ছিল ওনার যত আনন্দ।’
তাই নিজের ব্যবসার শুরু থেকেই সিভিল কনস্ট্রাকশনের ঠিকাদারি ব্যবসায়ও যুক্ত ছিলেন আনোয়ার হোসেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজগুলো তিনি নানাজনকে নিয়ে করিয়ে নিতেন, কিন্তু তত্ত্বাবধান করতেন নিজে। এতে করে স্থপতি, প্রকৌশলী, নির্মাণ ঠিকাদারদের একটা বড় নেটওয়ার্ক তিনি গড়তে সক্ষম হন। যেহেতু বানানোতে আনন্দ পেতেন, তাই আনোয়ার গ্রুপের সব কারখানার ভৌত অবকাঠামো নিজেরাই নির্মাণ করেছেন। আর এভাবে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে গ্রুপের একটা বিশেষ সক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়।
২০০২ সালে সেই সক্ষমতাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন আনোয়ার হোসেনের বড় পুত্র মানোয়ার হোসেন। যাত্রা শুরু করে আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক। তাদের প্রথম দুটি প্রকল্প নবাবপুর টাওয়ার ও উদয়ন অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প।
১৯৮-২০২ নবাবপুর রোডে অবস্থিত নবাবপুর টাওয়ার একটি বাণিজ্যক ভবন। এই বহুতল ভবনে বর্তমানে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে।
কল্যাণপুরের হোসেন হাউজিংয়ের উদয়ন অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পটি আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের একটি মাইলফলক প্রকল্প। প্রায় ১২ বিঘা জমির ওপর মোট ১২টি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। পাঁচটি ইতিমধ্যে হস্তান্তর করা হয়ে গেছে। অন্যগুলো চলমান। এই প্রকল্পের ভবনগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিকে (ডেসকো) প্রকল্প থেকে ৮ কাঠা জমি দান করা হয়। সেখানে তারা একটি বিদ্যুৎ সাবস্টেশন নির্মাণ করেছে, যা আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করে।
‘আমাদের অন্যান্য উদ্যোগের মতো শুরু থেকেই এটি আমরা পেশাদার প্রকৌশলী, স্থপতিদের হাতে চালনা করতে দিয়েছি। শুরুতে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন বেসরকারি খাতের অ্যাপার্টমেন্ট ও কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স তৈরিতে অগ্রগণ্য প্রকৌশলী সাদত সেলিম। সেই থেকে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর পদটি একজন প্রকৌশলীরই থাকে,’ জানালেন হোসেইন খালেদ। ‘আর দর্শন হিসেবে বাবার কয়েকটা উপদেশ আমরা প্রথম থেকে মেনে চলছি।’
প্রথমটি হলো, আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক যেসব জমিতে প্রকল্প করে, সেগুলো বন্ধক রেখে কোনো ব্যাংকঋণ নেয় না। প্রয়াত শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন মনে করতেন, জমি বন্ধক রেখে ঋণ করা হলে জমির মালিকের মনে একধরনের অস্বস্তি তৈরি হতে পারে। তিনি সেটি চাইতেন না। খালেদ জানালেন, একই রকম অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এ ব্যাপারে তাঁদের কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। কারণ, আনোয়ার গ্রুপের বিল্ডিং উপকরণ, যেমন রড, সিমেন্ট, সিমেন্ট শিট, পলিমারের কারখানা রয়েছে। ফলে গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক পায়। ‘আমাদের প্রকল্পগুলোতে আমরা আমাদেরই ইস্পাত, সিমেন্ট ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করি,’ বলেন হোসেইন খালেদ।
দ্বিতীয়ত, জমির মালিককে অগ্রাধিকার দেওয়া। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ভাষায়, ‘আমরা সিমেন্ট-কংক্রিটের রংতুলি দিয়ে অন্যের স্বপ্ন বুনি। সে কারণে প্রকল্পের নকশা করার সময় জমির মালিকের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নির্মাণকাঠামোর শর্ত ও রাজউকের নিয়ম অনুসরণ করে তাঁর স্বপ্নকে আমরা বাস্তবে রূপ দিই।’
নকশাতে আলো–বাতাসের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং কমপ্লেক্সে সবুজের ছোঁয়া রাখা তাই আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের প্রকল্পগুলোর বৈশিষ্ট্য। তাদের প্রকল্পের নামগুলোতেও এই বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ থাকে। মনসুন ব্লু, নীল আকাশ, সিনথিয়া, রেইন ফরেস্ট, স্কাই গার্ডেন, হুইসপারিং গ্রিন, হুইসলিং উডস—তাদের কয়েকটি প্রকল্লের নাম।
হোসেইন খালেদ বলেন, ‘অনেকেই এখন মা–বাবাকে নিয়েই নিজের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে চান। একই সঙ্গে চান দূরদূরান্ত থেকে আগত আত্মীয়স্বজন যেন প্রয়োজনে তাঁর বাড়িতে থাকতে পারেন। এ বিবেচনা থেকে আমরাই চার বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ডিজাইন করতে শুরু করি। আমাদের অপেক্ষাকৃত ছোট ফ্ল্যাটেও (১৪০০-১৬০০ বর্গফুট) আমরা চারটা বেডরুম রাখার চেষ্টা করি।’
আলাপচারিতায় জানা গেল, নির্মাণসামগ্রীর মান ও পেশাদারি তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক কোনো ছাড় দেয় না। প্রকল্প এলাকায় সার্বক্ষণিক পুরকৌশলীদের তত্ত্বাবধান যেমন থাকে, তেমনি সুপারভাইজার ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তদারকিতে যেতে হয় নিয়মিত।
এতক্ষণে বুঝলাম, কেন আজ অফিসে বেশি লোক নেই। শনিবার নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের আবশ্যিকভাবে প্রকল্প ভিজিটে যেতে হয়।
২০০২ সালে যখন আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক যাত্রা শুরু করে, তখন রাজউকের নিজেরও শেখার পালা চলছিল বলে মনে করেন হোসেইন খালেদ। ফলে অনেক কিছুতেই সেভাবে নজরদারি ছিল না। ১৯৯৫ সালের বিল্ডিং কোড থাকলেও সেটার প্রয়োগ তেমন একটা জোরদার ছিল না। ফলে অনেক ভৌত কাঠামো গড়ে উঠেছে, যেখানে অগ্নিনিরাপত্তা কিংবা দুর্ঘটনার বিষয়গুলো অনেকে মানতেন না। নতুন বিল্ডিং কোড হওয়ার পর এখন সেগুলোতে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।
হোসেইন খালেদ মনে করেন, ‘আমাদের দেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলো ইতিমধ্যে এসব সেফটি সিকিউরিটিতে বৈশ্বিক মান অর্জন করেছে। কিন্তু দেশের অ্যাপার্টমেন্ট বা বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে এর কঠোর প্রয়োগ এখনো সেভাবে শুরু হয়নি। অনেক বাণিজ্যিক, এমনকি আবাসিক ভবনের ছেড়ে দেওয়া জায়গা বা গ্যারেজকে গুদাম বানানো হয়। অনেক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ড্রাইভওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।’ ডেভেলপাররা ভবন হস্তান্তরের সময় বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিয়ে এলেও পরে এগুলো আর নকশা মোতাবেক ব্যবহৃত হয় না। এর নানামুখী কারণ থাকলেও রাজউকের তদারকি আরও বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
হোসেইন খালেদ মনে করেন, আগুন বা অন্য দুর্ঘটনার সময় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে বিশেষ কার্যক্রম এখনই শুরু করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের উদাহরণ দিলেন তিনি। সেখানে যেসব ভবনের ভেতরে নতুন করে অগ্নিনির্গমনব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়নি, সেখানে ভবনের বাইরে আলাদা করে স্টিলের সিঁড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘আমাদের গার্মেন্টসগুলোতেও একই কাজ দেশেও করা হয়েছে। তাহলে তা কেন বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে (যেগুলোতে এ ব্যবস্থা নেই) করা যাবে না?’ প্রশ্ন উত্থাপন করলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
খোলামেলা, আলো–হাওয়ার প্রাচুর্য আর সবুজের ছোঁয়া রেখে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন বুনে যেতে চান হোসেইন খালেদ। বাবার মতো তিনিও প্রকল্পের জমি বাছাই করার সময় খেয়াল রাখেন, মসজিদ কোন দিকে, সেদিকে জানালা দেওয়া যাবে কি না। ভাবেন, ওই ভবনে যাঁরা থাকবেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা যেন খেলার একটা জায়গা পায়, প্রকৃতির সঙ্গে তারা যেন বেড়ে উঠতে পারে। ভাবেন, দেশের রিয়েল এস্টেট শিল্পের সমস্যাগুলো সমাধানে অন্যদের সঙ্গে কাজ করবেন, যেমনটি এখন করেন।
আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের কোনো প্রকল্পে থাকতে হলে কোনটিকে বাছাই করবেন—এই প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, গুলশানের ৭১ নম্বর সড়কে নতুন একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, নকশা হচ্ছে, নানা দিক দেখা হচ্ছে। সেটিতে আলো-হাওয়া যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে সবুজের সমারোহ। যদি ল্যান্ডমার্কের কোনো প্রকল্পে থাকতে হয়, তাহলে সেটিকে এগিয়ে রাখবেন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখন ধানমন্ডিতে নিজেদের বাড়িতে থাকেন হোসেইন খালেদ।
আলাপচারিতার কোন ফাঁকে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, টের পাইনি। আমাদের আলোকচিত্রী কবীর হোসেনের তাড়ায় আমরা চলে এলাম বায়তুল হোসেন ভবনের ছাদে। সেখানে জড়ো হলেন ল্যান্ডমার্কের কর্মীদের একাংশ। তাঁদের মাঝখানে দাঁড়ালেন হোসেইন খালেদ। সবাই মিলে তাকালেন আকাশের পানে।
যে আকাশ তাঁরা ছুঁতে চান নিজেদের পেশাদারত্ব, ভালোবাসা, মায়া, নিষ্ঠা, সততা ও কাজের মান দিয়ে।
লেখাটি বর্ণিল বসত জানুয়ারি ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত