‘বাচ্চা কি বুকের দুধ পায়’

সন্তান জন্ম দেওয়ার পর অসম্ভব কঠিন একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যান নতুন মা। বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ (১-৭ আগস্ট) উপলক্ষে নিজের সেই সময়ের অভিজ্ঞতা লিখেছেন নতুন মা নাদিয়া মাহমুদ

ব্রেস্টফিডিং একটা প্রাকৃতিক ও জরুরি ব্যাপার

মা হওয়ার পর এ প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি শুনেছি। প্রথম কয়েক দিন এ প্রশ্নের মানেই আমি বুঝিনি। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সাত মাস পর থেকেই আমার প্রিমিল্ক লিকেজ (সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মায়ের বুকে দুধ আসা) শুরু হয়। জন্মের পর সন্তানকে যখন শালদুধ দিতে বলে, তখনো সে দিব্যি খেতে পারছিল, মানে আমার বুকে দুধ আসছিল। তবে বারবার ওর (শিশুর) মুখ থেকে স্তনবৃন্ত বের হয়ে যাচ্ছিল।

সদ্য জন্ম নেওয়া একটা শিশু খাওয়ার পদ্ধতি জানবে না—এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে তত দিনে আমি জেনে গেছি, পর্যাপ্ত দুধ বাচ্চা তখনই পাবে, যখন মা তাঁর পুরো এরিওলা (স্তনবৃন্তসহ পুরো কালচে অংশ) শিশুর মুখে দেবেন। সে চেষ্টাই করছি, কিন্তু যতবারই দিই, সন্তান পুরোটা মুখে রাখতে পারে না। খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ে, বারবার তখন মুখ থেকে স্তনবৃন্ত বের হয়ে যায়। আমার এক হাতে ক্যানুলা, ওদিকে অস্ত্রোপচারের পর সেলাইয়ের জায়গায় তীব্র ব্যথা আর রক্তপাতের আশঙ্কা। সোজা হয়ে বসতে পারি না, তাই বাচ্চা কীভাবে খাচ্ছে, তা–ও দেখতে পারি না ঠিকমতো। খাওয়ানোর সমস্যার কথা যতবারই বলি, নার্সরা এসে ঠিক করে দিয়ে যান আর বলেন আস্তে আস্তে শিখে ফেলবে। তখন বাচ্চা কাঁদলে তাকে খেতে দিয়ে শান্ত করাই যেন ছিল মূল কাজ। নিজের হরমোনাল ওঠানামা, শারীরিক ক্লান্তি, অস্ত্রোপচারের ঝক্কি সামলে এসব বিষয়ে খেয়াল করার কথা মনেই ছিল না। ফলাফল, তিন দিনের মাথায় স্তনবৃন্ত ফেটে রক্ত বের হওয়া শুরু হলো। ওই সময় বাচ্চার খিদে পেলেই আতঙ্কিত হয়ে যেতাম। ব্যথায় কাতর আমি কীভাবে সন্তানকে এমন স্তন দেব বুঝতে পারতাম না। বাচ্চা খাওয়ার জন্য কাঁদে আর আমি কাঁদি ব্যথা ও ভয়ে।

শুরুতে একটি স্তনবৃন্ত বেশি ফেটে যাওয়ায় ওদিক খাওয়ানো বন্ধ রাখি। এতে সেদিকের দুধ জমে স্তন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল। নার্সরা বললেন, ব্যথায় জ্বর এসে যাবে। ম্যানুয়াল পাম্প কিনুন। এরপর পাম্প করে দুধ ফিডারে ভরে খাওয়াতে থাকলাম। ফেটে যাওয়া নিপল পাম্প করায় আরও বেশি রক্তাক্ত হয়ে যায়। এ অবস্থায় বাচ্চাকে খাওয়াব কীভাবে? তারপরও ডাক্তাররা বাচ্চাকে ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে দেবেন না। তাঁরা নিপল সারানোর জন্য মলম দিলেন, নানা রকম টোটকা দিলেন, কিন্তু নিরাময় তো আর চোখের নিমেষে হয় না। তত দিন বাচ্চা কী খাবে? তারপরও ডাক্তারদের সাফ কথা, ‘বাচ্চার যদি ক্ষতি করতে চান, তাহলে বাইরের দুধ দেবেন!’ কিন্তু মা হয়ে সন্তানের খিদের কান্না সহ্য করতে না পেরে পাঁচ দিন বয়সে ওকে ফর্মুলাই দিই। আর স্তন স্বাভাবিক করার সব রকম চেষ্টা করতে থাকি। প্রথম দিন থেকে বাচ্চাকে ঠিকমতো দুধ খাওয়াতে পারলে মা-মেয়ে দুজনেরই হয়তো এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, হাসপাতালে আমাকে খুব ভালো চিকিৎসা ও সেবা দিলেও বুকের দুধ খাওয়ানো সম্পর্কে কোনো জ্ঞান আমাকে দেওয়া হয়নি। শুধু বলেছেন, ‘খাওয়ান।’ যতবার যত ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলেছি, বাচ্চাটা খেতে পারছে না, তাঁরা খালি বলেন, ‘পুরো কালো অংশ মুখে দেবেন।’ আমি যতই বলি, দিই কিন্তু সে রাখতে পারে না, ছেড়ে দেয়, সে কথা কেউ শোনে না।

এভাবে ভুলভাল পদ্ধতিতেই বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। কিছুদিন পরপরই তাই আমার সমস্যা হতো। সন্তানেরও পেটে গ্যাস হয়ে গেল। এরপর কোলিক বেবি নিয়ে সে আরেক যুদ্ধ। টানা ৪৫ মিনিট ধরে বাচ্চা খাওয়ার পরও স্তন খালি হতো না। আউন্স আউন্স দুধ পড়ে জামাকাপড় ভিজে যেত। অথচ পরিবারের কাছে গল্প শুনি, ‘অমুকের বুকে দুধের সাগর-মহাসাগর ছিল, তমুকের নাকি দুধের এমন ফ্লো যে বাচ্চা খেয়েও শেষ করতে পারে না।’ বুকের দুধ বাড়ানোর জন্য এই খাও, সেই খাও বলে হাজারো খাবার হাজির করেন বাড়ির সবাই। শুরু হয় আরেক ধরনের অত্যাচার। গলা দিয়ে খাবার নামে না। ওদিকে ফিনকি দিয়ে দুধ বের হয়ে বাচ্চার চোখ-মুখ ভিজে যাচ্ছে, তবু শুনি বাচ্চা নাকি দুধ পাচ্ছে না।

কতজন কত কথা বলে। তবে একবারের জন্যও কেউ বলে না, বাচ্চাকে এভাবে ধরো, এভাবে খাওয়াও। কেউ একটুও আঁচ করতে পারে না যে ওর হয়তো টেনে খেতে কষ্ট হয়। বলবে কখন? সবাই তো এটাই প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে মায়ের বুকে পর্যাপ্ত দুধ নেই।

বাচ্চার যখন প্রায় দুই মাস, তখন তার কিছু শারীরিক সমস্যা ধরা পড়ে। সেই সমস্যার জন্যই হয়তো তার টেনে খেতে কষ্ট হতো। আর দুধ একটু বেশি বের হলেই বিষম খেয়ে যেত। আমি আবারও ডাক্তারের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ব্রেস্ট পাম্পের সিদ্ধান্ত নিই, তার আগে ল্যাকটেশন এক্সপার্টের কাছ থেকে ব্রেস্টফিডিং বিষয়ে বিস্তারিত জানি। তত দিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। এদিকে বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতাল, ডাক্তার আর ল্যাকটেশন এক্সপার্টের কাছে ঘুরতে ঘুরতেই দিন চলে যায়। যে শিশুবিশেষজ্ঞ বাচ্চাকে বোতলে দুধ দিতে নিষেধ করেছেন, তাঁর চেম্বারের বাইরেই কোনো ব্রেস্টফিডিং কর্নার নেই। যেসব জায়গায় বাচ্চাকে টেস্ট করাতে যাচ্ছি, সেখানেও নেই। অনেক খুঁজে যেখানে পাচ্ছি, দেখা যাচ্ছে সেখানের অবস্থা খুবই করুণ। বসে থাকতেও গা গুলায়। এই সাত মাসে আমি একাধিক ক্লিনিক, ডাক্তারের চেম্বার, সুপারশপ ও রেস্টুরেন্টে গিয়ে শিশুকে ব্রেস্টফিডিং করানোর কোনো জায়গা খুঁজে পাইনি। সন্তানকে বুকের দুধে উৎসাহিত করা একটা জাতির এই হলো বাস্তব পরিস্থিতি।

বিষণ্নতা, সন্তানের অসুস্থতা নিয়ে চিন্তা আর নির্ঘুম রাত আমার দুধের প্রবাহ এবার সত্যিই কমিয়ে দিতে থাকে। ওষুধ, সাপ্লিমেন্ট, ঘরোয়া টোটকা চলতে থাকে, কিন্তু বাচ্চা তার শারীরিক অসুবিধার জন্য ঠিকমতো খেতে পারে না। আমি তাকে এবার পুরো পাম্প করে খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। একসময় সেটা পর্যাপ্ত না হওয়ায় পাশাপাশি ফর্মুলা দিতে থাকি, আর নিজেকে ভাবতে শুরু করি একজন খারাপ মা। কারণ, হাতে ফিডার দেখলেই শিশুর দর্শনার্থীরা একেকজন আঁতকে উঠত। কতজনকে যে বলতে হয়েছে, আমার বাচ্চা বুকের দুধও ফিডারে খায়। কারণ, এটা টানতে ওর অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট হয়। বাচ্চাকে বাসায় আনার পর এমন কোনো দিন নেই, আমি কাঁদিনি। বাচ্চাকে শুধু ব্রেস্টফিড করানোর জন্য কত যে উদ্ভট পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু আমি যতই চেষ্টা করেছি, সমাজ ততই আমার সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করেছে।

তবে এ সময়ে প্রতিটি ধাপে আমি সন্তানের বাবার সাপোর্ট পেয়েছি। সে–ই আমাকে প্রথম এটা বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছে যে আমি যেভাবে যা-ই বাচ্চাকে খাওয়াই না কেন, আমিই আমার সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালোটা করছি। ফ্লো কমতে কমতে যখন প্রতি পাম্পে মাত্র দু–এক আউন্স দুধ আসা শুরু করল, তখন আমার কয়েকজন বান্ধবীও আমাকে সাহস জোগানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছে। আমাকে বুঝিয়েছে, একজন হাসিখুশি মা-ই একটা হাসিখুশি সন্তান বড় করতে পারে। তাই ব্রেস্টফিড না করাতে পারলেই যে আমি ব্যর্থ মা—এ চিন্তা থেকে দূরে সরে আসি।

ব্রেস্টফিডিং একটা প্রাকৃতিক ও জরুরি ব্যাপার, কিন্তু এটা কঠিন। যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রস্তুতি ও আশপাশের সবার সহযোগিতা ছাড়া এটা সফল হয় না। আমরা যেন ব্রেস্টফিডিং মাকে সম্মান করি। কিন্তু যাঁরা পারেনি তাঁদের যেন অসম্মান না করি। কারণ, প্রতিটি মা–ই তাঁর সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালোটা চান।