নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে লিখেছেন রুবাইয়াৎ জাহান (অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), সুবর্ণা সরকার (সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ডিসিপ্লিন, শিক্ষা স্কুল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়), নওরীন ইয়াসমিন (সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ইফফাত নাওমী (সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত পাঠ্যবইগুলো এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে আমাদের শিক্ষার্থীদের হাতে। নতুন এই শিক্ষাক্রমের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে সবার ভেতরে অনেক কৌতূহল আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের একটি অংশের কাছে নতুন শিক্ষাক্রম এবং বই নিয়ে বেশ ভুল ধারণা বিরাজ করছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে রচিত বইগুলো সত্যিকার অর্থে কতটা সময়োপযোগী এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কতটা জরুরি, শিক্ষাকর্মী হিসেবে তা পাঠক তথা অভিভাবক, শিক্ষক ও অংশীজনের কাছে তুলে ধরার দায়বদ্ধতা আমাদেরও।
বাংলাদেশ কেন এই নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করল? প্রথমত, বহুল আলোচিত নতুন এই শিক্ষাক্রম ‘রূপকল্প ২০৪১’–এর ধারক হিসেবে কাজ করবে বলে আমরা মনে করছি। ‘রূপকল্প ২০৪১’ একটি দূরদর্শী পরিকল্পনা, যেখানে বলা হয়েছে, ‘পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে।’ রূপকল্প ২০৪১-এর প্রধান চাওয়াগুলোর একটি হলো মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, যেখানে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের সবাই হবে মানসম্মত শিক্ষাপ্রাপ্ত, পাবে উন্নততর সামাজিক ন্যায়বিচার এবং একটি অধিকতর ন্যায্য আর্থসামাজিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ। নতুন শিক্ষাক্রম এই চাওয়াগুলো বাস্তবায়নের একটি অবশ্যপ্রয়োজনীয় ধাপ।
দ্বিতীয়ত, আমরা এমন একটি সময়ে বসবাস করছি, যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের প্রকৃতি, প্রয়োজনীয়তা এবং সক্ষমতায় বড় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোতে শুধু পুঁথিগত জ্ঞান দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাল্লা দিতে এখন আরও বেশি বিচক্ষণ, বিশ্লেষণধর্মী এবং সৃজনশীলতার মতো দক্ষতার অধিকারী হতে হবে। এ কারণে, দেশের জনগোষ্ঠীকে আসন্ন কর্মক্ষেত্রের জন্য সক্ষম করার লক্ষ্যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাতেও একটি বড় পরিবর্তন আবশ্যক। নতুন শিক্ষাক্রম সেই আবশ্যকতা নিশ্চিতকরণের একটি প্রয়াস।
তৃতীয়ত, এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে। এখন শিক্ষার্থীরা শিখবে সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে, হাতে-কলমে কাজ করে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে, শুধু মুখস্থ করে খাতায় লেখার মাধ্যমে নয়। অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়কে তারা নিজেদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে সব রকম পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলতে শিখবে। এর ফলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে গিয়ে রাষ্ট্র তথা সমাজ তার প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষ নাগরিক পাবে।
প্রণীত প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে জাতিধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী যেন সমানভাবে একাত্ম হতে পারে, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বইগুলোতে বিভিন্ন কার্যক্রম এমনভাবে দেওয়া হয়েছে, যেন প্রত্যেক শিক্ষার্থী একটি কৌতূহলী এবং আনন্দদায়ক শিখন-শেখানো পরিবেশের মাধ্যমে তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে। যেমন গণিত বিষয়ে জ্যামিতিতে ক্ষেত্রফলের সূত্র মুখস্থ না করিয়ে সরাসরি হাতে-কলমে শিক্ষার্থীদের চারপাশের পরিচিত বস্তুর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ পরিমাপ করিয়ে ক্ষেত্রফলের ধারণা শেখানো হচ্ছে। আবার ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা স্প্রেডশিট কাকে বলে, কত প্রকার ইত্যাদি মুখস্থ না করে নির্দিষ্ট সমস্যার আলোকে চারপাশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে স্প্রেডশিট তৈরি করছে। ফলে তাদের অর্জিত জ্ঞান দক্ষতায় রূপান্তরিত হচ্ছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বারবার যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, তা হলো নতুন শিক্ষাক্রমে ‘পরীক্ষাপদ্ধতি’ থাকছে না। আদতে পরীক্ষাপদ্ধতির ধরনে একটি পরিবর্তন এসেছে; তবে ‘পরীক্ষাপদ্ধতি’ থাকছে না—এমনটি অবশ্যই নয়। এত দিন মূল্যায়নপদ্ধতি ছিল মুখস্থনির্ভর এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে খাতায় লিখে তা সম্পন্ন করতে হতো। কয়েক ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষার পরিবর্তে এখন একাধিক দিনের আরও নির্ভরযোগ্য, উন্নতমানের এবং শিক্ষার্থীবান্ধব মূল্যায়নপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন লিখিত কাজও রয়েছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর চাহিদা এবং সক্ষমতার বিবেচনায় নতুন এ মূল্যায়নপদ্ধতি অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। প্রত্যেক শিক্ষার্থী সত্যিকার অর্থে কতখানি শিখেছে, তা যাচাই করা এবং সে অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে তাকে সহায়তা করাই তো মূল্যায়নের উদ্দেশ্য। এই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিখনকে, তাদের অর্জনকে নয়।
যেকোনো পরিবর্তনই একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যায়। শিক্ষাবিজ্ঞানের ভাষায় বললে, একটি নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ বছর সময় নিতে পারে। একটি পরিবর্তন বা একটি নতুনত্ব ধরনকে গ্রহণ করতে প্রয়োজন আমাদের চিরায়ত অভ্যস্ততার বাইরে যাওয়ার মানসিকতা, যা অবশ্যই একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহনশীল মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি।
শিক্ষাক্রমের ধরন বা এর বাস্তবায়ন—এসব নিয়ে অংশীজনের মতামত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যেকোনো শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ননির্ভর করে মূলত শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কীভাবে এবং কতটুকু সম্পৃক্ত হতে পারছে তার ওপর। তাই নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে এর অন্যতম মূল চালক শিক্ষকদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। প্রণীত নতুন পাঠ্যবইগুলোতে অনেক বিষয় অভিনবভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা প্রচলিত শিক্ষাক্রমে ছিল না। এর যথাযোগ্য বাস্তবায়নের জন্য জরুরি শিক্ষকদের প্রস্তুতি। একদিকে যেমন শিক্ষকদের জন্য শিখন-শেখানোবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, অন্যদিকে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের উন্নয়নও জরুরি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, নতুন ইংরেজি বইগুলোতে লিটারেরি ফিচার, শৈলীবিদ্যা (স্টাইলিস্টিকস) এবং বিভিন্ন ধারার (জনরা) লেখনী–বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হয়েছে। ইংরেজির শিক্ষকেরা যে এ বিষয়গুলো জানেন না তা নয়। তবে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক পর্যায়ে এর ব্যবহার খুব সীমিত আকারে ছিল। কাজেই একজন ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পড়ানোর পদ্ধতিগত দিকগুলো যেমন মাথায় নিতে হবে, ঠিক একইভাবে প্রয়োজনীয় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানগুলো নিয়মিত চর্চা করতে হবে। উল্লেখ্য, নতুন বইগুলোর বাস্তবায়নের সুবিধার্থে প্রতিটি বিষয়ের শিক্ষক–সহায়িকা প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের প্রয়োজনীয় ধাপগুলো বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই নতুন শিক্ষাক্রম যাদের জন্য, যাদের নিয়ে আমাদের এত আয়োজন, সেই শিক্ষার্থীরা বিষয়টির সঙ্গে কীভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করবে? শিক্ষার্থীদের পারদর্শী করার লক্ষ্যে প্রতিটি বইয়ে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক বিভিন্ন কার্যক্রম দেওয়া হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিটি শিখন-শেখানো কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন, বইয়ের প্রতিটি নির্দেশনা অনুসরণ করা। বইগুলো শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা চাইলে বাড়িতেও নিজে নিজে বা পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় অনেক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারবে।
এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আমাদের অভিভাবকদের ভূমিকা অপরিসীম। তাঁদের সহায়ক দৃষ্টিভঙ্গি ও সহিষ্ণু মানসিকতা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। অভিভাবকেরা যদি শিক্ষার্থীদের নিয়মিত স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করেন এবং শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেন, তবে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন অনেকাংশেই সহজ হয়ে যাবে।
শিক্ষাকর্মী হিসেবে বলতে চাই, ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র এবং এর প্রকৃতি বর্তমানের নিরিখে অনুধাবন করা অনেকাংশেই দুরূহ। এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের সেই কর্মক্ষেত্রের উপযোগী করে তোলার লক্ষ্যেই প্রণীত। অংশীজনদের প্রত্যেকে যদি তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে সক্ষমতা দেখান, তবেই দূরদর্শী এই শিক্ষাক্রমের একটি নির্বিঘ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।