বখাটেদের ঔদ্ধত্যপনায় কিশোরীদের মা–বাবার থাকতে হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতায়
চা–দোকানি বাবার স্বপ্ন ছিল, মেয়ে অনেক বড় হবে। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়বে। সেই মেয়ের মৃত্যুর বিচার চাইতেই এখন আইনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বাবা। মেয়ের আত্মহত্যার বিচার চান পাবনার বেড়া পৌরসভার সান্যালপাড়ার জাইদুল হোসেন। এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সুস্মিতা। কিন্তু ১৭ জানুয়ারি কলেজ যাওয়ার পথে বখাটেদের উত্ত্যক্তের শিকার হন ১৮ বছরের এই তরুণী। বখাটেদের হাতে মারধর খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। এমন অপমান মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। সুস্মিতার মতো এমন ঘটনা আমরা প্রায়ই শুনছি, দেখছি। বখাটেদের উৎপাতে নিরুপায় হয়ে কিশোরীকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন মা–বাবা, নয়তো বন্ধ করছেন পড়াশোনা। ২০ বছর আগে আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি, তখনো আমাদের লিখতে হয়েছিল বখাটের উৎপাতে গলায় দড়ি দেওয়া নারায়ণগঞ্জের চারুকলার শিক্ষার্থী সীমা বানু সিমিকে নিয়ে, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের সম্ভ্রম বাঁচানো ছোট্ট তৃষাকে নিয়ে। কত কিছুই তো বদলাল। কিন্তু এখনো আগের মতোই আছে সেই চিত্র। বরং আগের চেয়ে আরও প্রকট এবং ভয়ংকর রূপ নিয়ে বাড়ছে বখাটেদের ঔদ্ধত্যপনা। কিশোরীদের মা–বাবার থাকতে হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতায়। সন্তানকে একা রাস্তাঘাটে ছাড়তে ভয় পান তাঁরা। যতক্ষণ না ঘরে ফেরে মেয়ে, দুরুদুরু করে মায়ের বুক। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায়ই কি নেই? কীভাবে এই সামাজিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে নিরাপদে রাখা যাবে আমাদের সন্তান? বিশেষজ্ঞেরা জানালেন মতামত।
সামিনা লুৎফা
সহযোগী অধ্যাপক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বখাটেদের উৎপাত সব সময় ছিল। এখনো আছে। আগের মানুষ সামাজিক ছিলেন, একে অপরের বিপদে এগিয়ে যেতেন, আর এলাকার বখাটেরা প্রবীণ, গণ্যমান্যদের মান্য করতেন। তাই তাঁরা মুরব্বিদের সামনে উৎপাত কম করতেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা ছিল।
এখনকার মানুষেরা এককেন্দ্রিক। আর নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য কিশোর-তরুণেরা অনেক বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। আমরা দেখি, ঘটনাটি ঘটার পর প্রশাসন পদক্ষেপ নিচ্ছে, তারা যদি আগেই এলাকাভিত্তিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিয়ে রাখত, তাহলে বখাটেদের তাণ্ডব কমত। প্রশাসনের আন্তরিক উদ্যোগ জরুরি। প্রতিটি এলাকার বয়স্ক নারীরা মিলে সামাজিক প্রতিরোধের জন্য সংঘ করতে পারেন। এমন সামাজিক উদ্যোগগুলো সমাজে শৃঙ্খলা
ফিরিয়ে আনবে।
মেখলা সরকার
সহযোগী অধ্যাপক
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
ঘটনাটি দুঃখজনক। তবু বলছি, আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। কিশোরীরা যখন বখাটে দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়, তখন তারা একটা ভীতি, উদ্বেগ আর হীনম্মন্যতার মধ্য দিয়ে যায়। এই যে মানসিক চাপ, এর ধকলটা অনেক কিশোরীই সইতে পারে না। পরিবারকে তখন তাদের মানসিক সহায়তা দিতে হবে। তাকে দোষারোপ না করে সাহস জোগাতে হবে। কিশোরী কিংবা তরুণীদের জন্য পরামর্শ, রাস্তায় অথবা অন্যত্র উত্ত্যক্তের শিকার হওয়ার সময় বখাটেদের উপেক্ষা কোরো। দিনের পর দিন উপেক্ষায় একসময় হাল ছেড়ে দেবে। আর মা–বাবার জন্য পরামর্শ, সন্তানকে সামাজিক মেলমেশায় সহায়তা করুন। এতে করে সন্তানেরা আত্মবিশ্বাসী হবে, সব ধরনের পরিস্থিতি এবং মানসিক চাপ মোকাবিলা
করতে পারবে।
মিতি সানজানা
ব্যারিস্টার
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি অন্যদের বিরক্ত করে, অশ্লীল কাজ করে, তাহলে তাঁর তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ
রাস্তায় বা কোনো প্রকাশ্য স্থানে নারীকে অপমান বা বিরক্ত করে, তবে সেই
ব্যক্তিকে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের আইন অনুযায়ী, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তখনই অপরাধ আমলে নিয়ে শাস্তি দিতে পারবেন। এই আইনে শাস্তি হবে সর্বোচ্চ দুই বছর।
পুলিশ নিজে বাদী হয়েও মামলা
করতে পারে।
তাসলিমা আকতার
সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি ও নারী অধিকারকর্মী
বখাটের উৎপাত, নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে এটি নারীর প্রতি অবমাননার মনোভাব। নারীকে ছোট করে দেখা, তাকে পণ্য কিংবা ঊনমানুষ ভাবা, এমন সংস্কৃতি সমাজে বিরাজ করছে। পাবনার ঘটনা তারই দৃষ্টান্ত। এই ঘটনা
যাঁরা ঘটিয়েছেন, তাঁদের শাস্তি দাবি করছি। আমাদের সমাজে নারীকে হেয় করা, প্রতিনিয়ত নারীর নির্যাতিত হওয়া দেখে দেখেই একজন পুরুষ বড় হয়, পরে সে–ও নিপীড়ক হয়। এটার জন্য দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আত্মহত্যা সমাধান নয়। লড়াই করতে হবে। এলাকায় এলাকায় সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধের শক্তি
গড়ে তুলতে হবে। এই লড়াইয়ের শক্তির
মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক যে বৈষম্য আছে, তা রোধ করতে হবে। তাহলে উত্ত্যক্তের
হার কমবে।