আন্দোলন, সংগ্রাম ও গণ–অভ্যুত্থান শেষে নতুন শুরুর স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষার্থীরা
আন্দোলন, সংগ্রাম ও গণ–অভ্যুত্থান শেষে নতুন শুরুর স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষার্থীরা

নতুন শুরুর স্বপ্ন দেখছে চুয়েট

চট্টগ্রাম নগর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) অবস্থান। সবুজ পাহাড়ের কোলে ১৮৮ একরের নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস। আন্দোলন–সংগ্রাম শেষে নতুন শুরুর স্বপ্ন দেখছেন ক্যাম্পাসের প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী। দেখতে গিয়েছিলেন তানবির আহমেদ চৌধুরী

চুয়েটেও ছিল ছাত্রলীগের দাপট। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রসংগঠনটির গ্রুপগুলো সময়ে সময়ে নিজেদের মধ্যেই মারামারিতে জড়াত। ভয় দেখিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এসব কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা হতো। মিটিং-মিছিল বা দলীয় কর্মসূচিতে যেতে না চাইলে হুমকিধমকি দেওয়া হতো, করা হতো মানসিক নির্যাতন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বদলে গেছে এই চিত্র। ক্যাম্পাসে কোনো দলীয় ছাত্রসংগঠনেরই এখন দাপট নেই। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন।

ক্যাম্পাসের আরেক আতঙ্কের নাম ছিল র‍্যাগিং। পরিচয় পর্বের নামে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের রাতভর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। প্রশাসনের সরব ভূমিকায় সেই চিত্রও বদলাতে শুরু করেছে। র‍্যাগিংয়ে জড়িত ১১ শিক্ষার্থীকে সম্প্রতি ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করেছে প্রশাসন।

গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রদের ওপর হামলাকারী ও ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনাকারী ছাত্রলীগের সদস্যের শাস্তির আওতায় আনার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের অধিকার আদায়ে একবিন্দু ছাড় দিতেও রাজি নন শিক্ষার্থীরা। জুলাই বিপ্লব শেষে পরীক্ষার খাতায় কোডিং, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার, ক্যানটিন ও ডাইনিংয়ের খাবারের মান বৃদ্ধি, শরীরচর্চা কেন্দ্র ও নবনির্মিত চিকিৎসা ভবন চালু ও মান বৃদ্ধিসহ ২২ দফা দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। দাবি পূরণ করতে নিয়মিত প্রশাসনকে তাগাদা দিচ্ছেন তাঁরা। এ ছাড়া যেকোনো অনিয়ম, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধেও তাঁরা সরব।

ক্যাম্পাসে কোনো দলীয় ছাত্রসংগঠনেরই এখন দাপট নেই

গবেষণা ও উদ্ভাবনীতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী

নিউরো মার্কেটিং নিয়ে গবেষণা করেছেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ফজলুল করিম খন্দকার, অধ্যাপক কাজী দেলোয়ার হোসেন ও সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী হাসান চৌধুরী। সহজ বাংলায়, নিউরো মার্কেটিং হচ্ছে ভোক্তার মস্তিষ্কের তড়িৎ সিগন্যাল পর্যালোচনা করে কোনো পণ্যের চাহিদার পরিমাণ নির্ধারণ। গবেষকদের তৈরি একটি ইজিজি যন্ত্রের মাধ্যমে ৩৭ শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের তড়িৎ সিগন্যাল থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। কোনো পণ্য একজন ভোক্তা সত্যিই পছন্দ করছেন কি না, তা পর্যালোচনা করাই লক্ষ্য।

ধানের তুষ থেকে সিমেন্টের বিকল্প উদ্ভাবন করেছেন পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জি এম সাদিকুল ইসলাম ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী নাদিরা ইসলাম। সাদিকুল ইসলাম জানান, ধানের তুষকে ৫৫০-৭৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পোড়ালে এমোরফাস সিলিকা উৎপন্ন হয়, যেটি সহজে সিমেন্টের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি অবকাঠামোর শক্তিমত্তা ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশদূষণ কমাবে বলে দাবি করেন তিনি।

সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদ হাসানের তৈরি অ্যাপ চিঠি ডট মি। অ্যাপটির মাধ্যমে নিজের পরিচয় গোপন রেখেই অন্যদের উদ্দেশে চিঠি লিখতে পারেন। মজার বিষয়, এই অ্যাপে লেখা চিঠি অনেকটা হাতে লেখা চিঠির অনুভূতি দেয়।

অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কীভাবে প্রকল্পের জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়, হাতে-কলমে তা শিখছেন নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থীরা

চুয়েটে স্থাপিত হয়েছে ‘নাসা-স্টেমএক্স-চুয়েট এসট্রোবি ভার্চু৵য়াল ল্যাব’। এখন থেকে শিক্ষার্থীরা ল্যাবে বসেই প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে একটি ফ্রি ফ্লায়িং রোবট (অ্যাস্ট্রোবি) নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশ স্টেশনে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে কাজ করতে পারবেন। তাঁদের কাজ মহাকাশ স্টেশনে প্রয়োগের সুযোগও পাবেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টেমএক্স-৩৬৫ ও চুয়েট যৌথভাবে এ ল্যাব চালু করেছে।

ঝুলিতে থাকা পুরস্কার

শুধু পড়াশোনা নয়, দেশ–বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও ভালো করছেন শিক্ষার্থীরা।

আগস্ট মাসে অ্যাকশনএইড ও দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত ক্লাইমেট জাস্টিস আইডিয়া প্রতিযোগিতায় ওয়াটার রাইটস ক্যাটাগরিতে ১৫৬টি দলকে পেছনে ফেলে বিজয়ী হয় কম্পিউটারবিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী সাবিক আফতাহী, পুরকৌশল বিভাগের তাজরীন তাবাসসুম এবং তানভীরুল ইসলামের দল ইউন্যানিমাস।

৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানার আয়োজিত আন্তবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ তালবি, কৌশিক কাব্য ও আবদুল্লাহ আবীর।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আয়োজিত এনার্জি ফেস্টে ক্যাড প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে গত ১৩ ডিসেম্বর ২০টি দলকে হারিয়ে বিজয়ী হয় ‘ক্যাডজিলা’। দলের সদস্য ছিলেন যন্ত্রকৌশল বিভাগের মুহতাসিমুল বারী, আসহাব বিন ফারুক ও মেহেদী হাসান৷

দেশ–বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও ভালো করছেন শিক্ষার্থীরা

শিক্ষার্থীরাই যখন উদ্যোক্তা

প্রকৌশলী তো হবেনই, পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবেও ভালো করছেন অনেক শিক্ষার্থী। কেউ শখের বশে, কেউ নিজের খরচ চালাতে ক্যাম্পাসেই শুরু করেছেন ছোট পরিসরে ব্যবসা।

শখ পূরণের ইচ্ছা থেকেই গয়না বিক্রি শুরু করেন সাদিয়া শারমিন। তিনি যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। রেজিন দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের মালা, লকেট, কানের দুল, আংটিসহ নানা রকমের গয়না তাঁর অনলাইন দোকানের মূল আকর্ষণ। অনলাইনভিত্তিক এই দোকানের নাম ‘ক্রাফটি পস’। পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসাকে বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা তাঁর আছে।

অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ’বুক উইন্ড’ এর মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেন পুরকৌশল বিভাগের তিনজন শিক্ষার্থী

বছরখানেক হয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের গ্যাজেট বিক্রি করেন ম্যাকাট্রনিকস ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাঈমুল হাসান। প্রথমে বন্ধুরাই ছিলেন ক্রেতা। এখন পরিসর বেড়েছে। ফেসবুকের মাধ্যমে দেশজুড়ে পণ্য বিক্রি করছেন। মাসে ৮০ হাজার টাকা করে আয়ের দাবি করে নাঈমুল বলেন, গ্যাজেটের পাশাপাশি ‘ওয়ার বেস্ট’ নামক প্ল্যাটফর্মে টি-শার্ট, হুডি ও জ্যাকেট বিক্রি করেন তিনি।

চুয়েটের আশপাশে ভালো লাইব্রেরি না থাকায় শিক্ষার্থীদের বই কিনতে যেতে হতো চট্টগ্রাম শহরে। এ কষ্ট কমাতে বই বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ’বুক উইন্ড’ গড়ে তোলেন পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত হাসান, সাকিব খান ও সাইদুর রহমান। সাশ্রয়ী মূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিতেই এই উদ্যোগ।

ক্যাম্পাসে আম, চালতা, আমলকী, জলপাইসহ বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু আচার তৈরি করে বিক্রি করেন ইটিই বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনিয়া তুরিন। শুরুতে হলের বন্ধুদের জন্যই বানাতেন। পরে তাঁদের উৎসাহেই বড় পরিসরে ‘ফ্লেভারস এরেনা’ নামের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আচার বিক্রি শুরু করেন তিনি।