এই মুহূর্তে পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ১৯৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি শুধু একজন সফল উদ্যোক্তাই নন, সফল উদ্ভাবকও। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, ইলন মাস্ক যে উদ্যোগই হাতে নেন না কেন, তা সফল হবেই হবে। কিন্তু দূরের ঘাস সব সময় সবুজই লাগে। বাস্তবে ইলন মাস্কের পথচলা মোটেও ততটা মসৃণ ছিল না, যতটা বাইরে থেকে মনে হয়। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে এক দীর্ঘ সংগ্রামের পথ। কোনো ব্যর্থতাই কখনো তাঁকে নিজের লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি; বরং ব্যর্থতা থেকেই একটু একটু করে শিখেছেন, সাফল্যের দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। আজ জানা যাক, ইলন মাস্কের কিছু ব্যর্থতা এবং সেসব ব্যর্থতার পথ পাড়ি দিয়ে সফল হওয়ার গল্প।
শুরুর দিকে ইলন মাস্ক বেশ কিছু টেক কোম্পানিতে আবেদন করে ব্যর্থ হন। কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল নেটস্কেপ। চাকরি না পেয়ে তিনি জিপটু নামক একটি বিজনেস ডিরেক্টরি তৈরি করেন। জিপটু ছিল টেলিফোন ডিরেক্টরির একটি অনলাইন ভার্সন।
জিপটুকে এখন খুব সাধারণ একটি আইডিয়া মনে হতে পারে। কিন্তু সে সময় এটি ছিল একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। কারণ, কম্পিউটারের প্রচলন তখন খুব বেশি ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত জিপটু প্রথম দিকে প্রচুর সংকটে পড়ে যায়। কারণ, বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই জিপটু প্রকল্পে বিনিয়োগ করার ব্যপারে আগ্রহী ছিলেন না।
১৯৯৬ সালে জিপটু কিছু বিনিয়োগ পায়। আশ্চর্যজনকভাবে, মাস্ককে জিপটুর সিইওর পদ থেকে হটিয়ে তুলনামূলকভাবে ছোট একটি পদ দেওয়া হয়। যাহোক, মাস্ক তাঁর পরবর্তী সিইও রিচার্ড সরকিনকে হটাতে সক্ষম হন। কারণ, দুজনের মধ্যে আদর্শগত অমিল ছিল প্রচুর।
বেশ কিছু সাফল্যের পর মাস্ক জিপটু বন্ধ করে দেন এবং নতুন একটি আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন, যা আজ পেপ্যাল নামে পরিচিত।
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, ১৯৯৯ সালে পেপ্যাল বছরের সবচেয়ে বাজে বিজনেস আইডিয়া হিসেবে ভোটে বিজয়ী হয়েছিল! সে সময় পেপ্যাল পামপাইলট ও হাতে বহনযোগ্য অন্যান্য ডিভাইসের সিকিউরিটি সফটওয়্যার হিসেবে এসেছিল।
পেপ্যাল ব্যবহারকারীরা যখন কোম্পানিটিকে ই–মেইল পাঠাতে শুরু করেছিলেন, তখন পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছিল যে ই-বেতে নিলামের জন্য পেপ্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই মাস্ক ও পেপ্যালের সহপ্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্স লেভচিন অনলাইন ওয়ালেট তৈরিতে মনোযোগ দেন। এর পর থেকে পেপ্যাল ফান্ড পেতে শুরু করে। ২০০২ সালে পেপ্যাল আত্মপ্রকাশ করে পাবলিক কোম্পানি হিসেবে।
টেসলা বাজারে আসার পর অটো ইন্ডাস্ট্রির অনেক বিশেষজ্ঞই বহু নেতিবাচক কথা বলেছিলেন। তাঁরা ভাবতেন, বৈদ্যুতিক গাড়ি কখনোই সাফল্যের মুখ দেখবে না। তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্য আরেকটু হলে সত্যি হতে যাচ্ছিল। ২০০৮ সালে অর্থের অভাবে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল টেসলা। মাস্ক তখন টেসলার ‘এস মডেলের’ গাড়ি উৎপাদনপ্রক্রিয়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলেন। এ অবস্থায় উপায় না পেয়ে ব্যক্তিগত সম্পদও কোম্পানির কাজে বিনিয়োগ করতে থাকেন মাস্ক। জানতেন, এতে তাঁর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।
পেপ্যাল বিক্রি বাবদ প্রাপ্ত অর্থসহ মোট ৩৫ মিলিয়ন ডলার মাস্ক নিজের পকেট থেকেই খরচ করেন, যাতে তাঁর কোম্পানিটা বেঁচে থাকে। মাত্র দুই বছরের মাথায় মাস্ক বলতে গেলে নিঃস্ব হয়ে যান। জীবন যাপন করছিলেন বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধারদেনা করে। এরপর খুব কম সময়ের মধ্যেই টেসলা লাভের মুখ দেখতে শুরু করে। এই কঠিন সময়ে মাস্ক এবং তাঁর কর্মচারীরা অসংখ্য শিফটে কাজ করতেন, এমনকি ফ্যাক্টরির মেঝেতেই ঘুমাতেন।
স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার পর প্রচণ্ড ব্যস্ত ১৬টি মাস কেটে গিয়েছিল শুধু এটুকু প্রমাণ করতে যে উদ্ধারকারী ড্রোন জাহাজ ব্যবহার করেও একটি রকেট অবতরণ করানো সম্ভব। প্রথম চেষ্টায় রকেটটির নির্ভুলতা দেখে অনেক বিশেষজ্ঞই অবাক হয়েছিলেন। তবে এ ক্ষেত্রে স্পেসএক্সের উন্নতি হচ্ছিল শ্লথগতিতে। অনেকে তখনো কোম্পানিটি বৈধ কি না, তা নিয়েই সন্দিহান ছিলেন।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি স্পেসএক্স সফলভাবে পরপর তিনটি রকেট অবতরণ করাতে সক্ষম হয়। গোলমালটা বাঁধে যখন কোম্পানিটি এই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে তিনবারের বদলে চারবার রকেট উৎক্ষেপণ করে। মাস্ক ও স্পেসএক্সের জন্য এটি ছিল একটি বিশাল আঘাত। মিডিয়াগুলোও এ ঘটনার ভীষণ সমালোচনা করেছিল।
সবাই ধরেই নিয়েছিল, এরপর স্পেসএক্সের কার্যক্রমে ভাটা পড়বে। কিন্তু মাস্ক ব্যর্থ মিশনগুলো থেকে সংগৃহীত ডেটার সদ্ব্যবহার করে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, মহাকাশ গবেষণার ব্যবসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি জোর গলায় বলেন, মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানো সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে প্রাণহানির আশঙ্কাও আছে। তবুও মাস্ক ও তাঁর দল এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করতে বদ্ধপরিকর। ২০২৩ সালের ২০ এপ্রিল স্পেসএক্স থেকে স্টারশিপ রকেটের প্রথম উড্ডয়ন সম্পন্ন করে। পরীক্ষামূলক এই রকেট উড্ডয়নের চার মিনিটের মাথায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ইলন মাস্ক আর বিতর্ক সব সময় হাত ধরাধরি করেই চলে। জীবনে তিনি অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া ছিল বেশ দীর্ঘমেয়াদি ও বহুল আলোচিত। মাস্ক বলেন, তখন তিনি গভীর ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে ২০০৮ সালের মন্দায় স্পেসএক্স ও টেসলার লাভের পরিমাণ শূন্য হয়ে পড়ে। মাস্ক আবারও প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান। এমনকি তখন দুটি কোম্পানির মধ্যে একটি বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাও করেছিলেন তিনি।
শেষ পর্যন্ত মাস্ক সিদ্ধান্ত নেন, অবশিষ্ট অর্থ দুই কোম্পানির মধ্যে ভাগাভাগি করার। সে বছরের শেষে নাসা স্পেসএক্সের সঙ্গে ছয় বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করে। সৌভাগ্যক্রমে মাস্কের দুটি কোম্পানিই ঝড় সামলে উঠে দাঁড়ায়।
গত ২৫ জানুয়ারি শেয়ার মার্কেটে টেসলার শেয়ারের ১৩ শতাংশ দরপতনের ফলে মাস্ক ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ হারিয়েছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তকমাও এর ফলে হারাতে হয়েছে লাক্সারি ব্র্যান্ড লুই ভুইতোঁর সিইও বার্নার্ড আর্নল্টের কাছে। যদিও এমন উত্থান-পতন তাঁর জীবনে মোটেও নতুন কিছু নয়।
২০২২ সালে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে খুদে ব্লগ লেখার সাইট টুইটার কিনে নেওয়ার জন্য একটি চুক্তি সই করেন ইলন মাস্ক। তারপর হঠাৎ সেই চুক্তি থেকে সরে আসতে চান। মাস্ক দাবি করেন, টুইটারে ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও স্প্যামের সংখ্যা কর্তৃপক্ষ যত দাবি করেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি।
যখনই মাস্ক তাঁর টুইটার কেনার চুক্তি থেকে সরে আসতে চান, তখনই ব্যাপারটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। মাস্কের এই চুক্তি ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তের প্রভাব টেসলার শেয়ারের মূল্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এরপর তৎকালীন টুইটার কর্তৃপক্ষের করা মামলার মুখোমুখি হওয়ার পর মাস্কের জনপ্রিয়তাও কমতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মাস্ক টুইটারের মালিকানা গ্রহণ করেন এবং টুইটার কর্তৃপক্ষ তাদের মামলা তুলে নেয়। এখন পর্যন্ত টুইটারে মাস্কের পথচলা মসৃণ হয়নি। টুইটার পরিচালনাকালে তাঁর গ্রহণ করা বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন আছে। যেমন গণহারে কর্মী ছাঁটাই, বিজ্ঞাপনদাতাদের অনাগ্রহী করে তোলা, ভেরিফায়েড আইডির চিহ্ন ব্লু টিক বাবদ প্রতি মাসে টাকা নেওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া টুইটার অধিগ্রহণের পর এক বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মাস্ককে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় টেসলার অংশীদাররাও তাঁদের কোম্পানির প্রতি মাস্কের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছেন। এর ফলে টেসলার শেয়ারের মূল্য বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই পড়তির দিকে।
যত ব্যর্থতা আর বিতর্কই থাকুক না কেন, ইলন মাস্ক নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রতিভাবান। ক্যারিয়ারজুড়েই নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন, কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি কখনোই। টেসলা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সফল বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। মহাকাশ পরিবহনের খরচ কমিয়ে আনার যে লক্ষ্য নিয়ে মাস্ক স্পেসএক্স গড়ে তুলেছেন, সেই উদ্দেশ্য আজ অনেকাংশেই সফল। ইলন মাস্কের ধৈর্য ও দূরদর্শিতা ছাড়া এসব এত দ্রুত হতো না। ইলন মাস্কের ব্যর্থতা, সাফল্য, উদ্ভাবন কিংবা পাগলামি বিশ্লেষণ করে অনেক কিছুই শেখার আছে।
সূত্র: প্রেসফার্ম ও ফোর্বস