গত দুই দশকে অনলাইন এখন নতুন বাস্তবতা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাই বাস্তব দুনিয়ার মতো অনলাইনেও কিছু আদবকেতা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইন বাস্তবতায় নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করবেন, তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ ই–মেইল লেখা থেকে শুরু করে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী শেয়ার করছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইন ব্যবহারকারীদের নেটিজেন (ইন্টারনেট দুনিয়ার নাগরিক) বলা হয়। ঠিক একইভাবে নেটিজেনদের আদবকেতাকে (এটিকেট) নেটিকেট বলা হয়। অনলাইনে যেসব নেটিকেট মেনে চলা জরুরি, সেটাই জেনে নিন—
ইন্টারনেট দুনিয়া যেন বাঁধাহীন ঘোড়দৌড়ের জায়গা। কোনো সীমানাহীন নদী। সেই নদীতে স্রোত থাকুক না থাকুক, নিজের আদবকেতা ঠিক রাখতে হবে। অফিসে কাজ করতে যেমন নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয়, তেমনি ইন্টারনেট দুনিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও নিয়ম আর আদবকেতা মানা প্রয়োজন। ব্যক্তি হিসেবে বাস্তব দুনিয়ায় আপনার যেমন ইমেজ, ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় তেমন ইমেজ তৈরি করে আপনার অনলাইন কার্যক্রম। তাই সেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই গুরুত্বপূর্ণ।
যাঁদের জন্ম ১৯৮০-১৯৯০ দশকে, তাঁদের বেশির ভাগ মানুষই এখন মা–বাবা। নিজে যেমন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তেমনি তাঁদের সন্তানেরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আছেন। মা–বাবা ও অভিভাবক হিসেবে তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। আমেরিকার একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী জেনিফার ঝু স্কট। শিশুদের মুঠোফোন নিয়ে তাঁর একটি টেড টক ৩০ লাখের বেশি মানুষ দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, মা–বাবা হিসেবে সন্তানের ছবি বা ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে উন্মুক্তভাবে শেয়ার করা যাবে না। গোপন আইডিতে প্রকাশ করলেও এসব তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মালিকানায় চলে যায়। এ ছাড়া আপনার অজান্তেই আপনার শিশুর ছবি বা তথ্যাদির স্ক্রিনশট অন্যরা নিতে পারে। আপনার শিশুরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দিন, তারা কী শেয়ার করবে।’
কোনো জায়গা সমন্ধে তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও সঠিক তথ্য ও ঠিকানা দিতে চেষ্টা করুন। অনেকেই আজকাল অনলাইনের ভুল তথ্যে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
ডিজিটাল দুনিয়াতে যা করবেন, তার চিহ্ন থেকে যায় কোথাও না কোথাও। আপনি ডিলিট করলেও অনেকভাবে সেটা অনলাইনে থেকে যায়। ব্যক্তিভেদে আমাদের কথার স্টাইল আলাদা হয়। তাই অনলাইনে উন্মুক্তভাবে যোগাযোগ না করাই ভালো।
অনলাইনে নাম ধরে ডাকা, গালিগালাজ করা কিংবা অশালীন কোনো বাক্য, ছবি ব্যবহার করা এড়িয়ে চলতে হবে। অন্যকে আক্রমণ করে কখনো ই–মেইল, সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো পোস্ট বা মেসেঞ্জার চ্যাটে কিছুই লিখবেন না। গোপনীয়তা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনলাইনে কী শেয়ার করছেন, কী প্রকাশ করছেন, বুঝেশুনে করবেন। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন। যে ভিডিও শেয়ার করছেন, সেখান থেকে অন্য কোনো তথ্য প্রকাশ হচ্ছে কি না, বুঝে নিন। আপনি হয়তো এমন কোনো ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করলেন, যা পরে বাণিজ্যিক কাজে আপনার অজান্তেই ব্যবহার হয়ে যাবে। এসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এখন তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ নানা কারণে আপনার কণ্ঠ, ছবি কিংবা ভিডিও অবাধে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারের সুযোগ আছে। তাই কোথায় কী দিচ্ছেন, তা খেয়াল রাখতে হবে। নিজের ছবি-ভিডিও প্রকাশে যেমন চোখ খোলা রাখবেন, তেমনি পরিবারের ছোট শিশু বা স্বজনের কোনো ছবি শেয়ার করলেও সে বিষয়টি মাথায় রাখুন।
এই ফেসবুকে দেখলাম অমর্ত্য সেন মারা গেছেন, দ্রুত তাঁর ছবি দিয়ে বড় শোকের বার্তা লিখে লাইকের অপেক্ষায় বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, অমর্ত্য সেনের মৃত্যুর সংবাদ ভুয়া। সেটার প্রমাণ দিতে হয়তো তিনি নিজেই লাইভে চলে এলেন। এমন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ও তারকাদের নিয়ে ভুল কিংবা মিথ্যা তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিন ছড়াচ্ছে। তাই তথ্য যাচাই করে পোস্ট শেয়ার করুন। ইঁদুর দৌড়ে নামার কোনো প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করে। সে ক্ষেত্রে আপনি নিজের যৌক্তিকতা বুঝে শেয়ার করবেন। অনলাইন আদবকেতার রীতি অনুসারে কোনো পোস্ট দেখলেই তার প্রতি সাড়া দেবেন না। অন্তত দ্রুত সাড়া দেওয়া যাবে না। এখন তো ভুল তথ্য কিংবা মিথ্যা তথ্যের বড় উৎস অনলাইনের নানা প্ল্যাটফর্ম। অ্যাডলার বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী জেমস হালবার্ট বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো পোস্ট দেখলে যৌক্তিকভাবে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। অনলাইনে কোনো তথ্য পেলে সেটার সঠিক উৎসের খোঁজ করুন। খোলা চোখে অনলাইনে তাকালে অনেক তথ্য জানতে পারবেন। সব তথ্যই হয়তো সত্য নয়। অনলাইন দুনিয়া বৈশ্বিকভাবে উন্মুক্ত। অনেক তথ্য সবার জন্য উপযুক্ত নয়, আবার কার্যকরও নয়। অনলাইনে অন্যকে হেয় করা যাবে না। আলাদা সংস্কৃতির মানুষের ভাষা ও আচরণকে খোঁটা দেওয়া যাবে না।’
বন্ধুদের আড্ডায় কোনো বিষয়ে তর্ক যদি এড়িয়ে চলতে চান, তাহলে সে বিষয়ে অনলাইনেও তর্ক না করা ভালো। কিন্তু কোনো বিষয়ে আপনার যদি জোরালো অবস্থান থাকে, তখন তর্কে লিপ্ত হতে চাইলে সতর্ক থাকবেন। বিতর্ক করুন যুক্তি দিয়ে। অন্যের ভাবনাকে সম্মান দিয়ে নিজের তথ্য উপস্থাপন করুন। যেকোনো বিষয়ে আপনার মতামত থাকতে পারে, কিন্তু তার জন্য তর্কে জিততে যুদ্ধে নামবেন কেন? পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গা থেকে অন্যকে শোনার চেষ্টা করুন। তর্ক কিংবা আলাপে যেন আপনি নতুন কিছু শেখেন, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিন। সত্যের সন্ধানে অনলাইনে নিজের কথা বলতে পারেন, অন্যের কথা শুনতে পারেন। অন্যের চোখে বিশ্ব কেমন, তা জানার চেষ্টা করুন। কোনো আলোচিত বিষয়ে মতামত দিতে চাইলে, কোথায় কথা বলছেন, তা খেয়াল রাখুন। সরাসরি অনলাইনে কোনো কিছু ভুল বলবেন না। তথ্যের উৎস কী, তা জিজ্ঞাসার মাধ্যমে যেকোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে পারেন।
অনলাইনে কিছু লেখার কারণে অন্য ব্যক্তির মন খারাপ হতে পারে। এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে সরাসরি যোগাযোগ করুন। মনোবিজ্ঞানী হালবার্ট বলেন, ‘আমরা তো এখন অন্যের সঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দিচ্ছি। আমি বন্ধুদের সঙ্গে কোনো অনলাইন তর্কে জড়ালে, তাকে ফোন করে কী অবস্থা জিজ্ঞাসা করি। কোনো বিষয়ে তর্ক থাকলে ফোনে সমাধান করার চেষ্টা করি। নেতিবাচক মতামতের বিরুদ্ধে অনলাইনের দেয়ালে যুদ্ধ না করাই ভালো। বিভিন্ন পোস্ট বা ই–মেইলে ভুল ভাবনার অবকাশ থাকে। কে কেমন ভাবে, কথা বলে তা কানে না শুনলে চলবে? কে কোন আগ্রহে বা উদ্দেশ্যে মতামত দিচ্ছে, অনলাইনে তা জানতে মুঠোফোনে কল করে কথা বলতে পারেন।’
আমরা পুরোনো দিনের কোনো বন্ধুর খোঁজ পেলে (স্কুলের বন্ধু), তার ছবি ও লেখা দেখে যোগাযোগ করতে চাই। অনলাইনে বন্ধুর খোঁজ পেলেও সরাসরি দেখা করে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। ফোনে নিয়মিত কথা বলুন। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বললে, যোগাযোগ রাখলে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। অনলাইনে কারও ইতিবাচক পোস্ট দেখে তাঁর বন্ধু হলেন, এই বন্ধুত্বের সঙ্গে ছোটবেলার বন্ধুকে মেলাবেন না। অনলাইন বন্ধুর কাছ থেকে একই রকম ইতিবাচক আচরণ প্রত্যাশা করা যাবে না। অনলাইন সম্পর্ক বাস্তবে আলাদা হবে, এটা মেনে নিন। সংযোগ তৈরির জন্য বাস্তবে দেখা করুন, সামাজিক আয়োজনে অংশ নিন। শুধু ইন্টারনেটই আপনার বন্ধু তৈরির জায়গা মনে করলে ব্যাপারটা নেতিবাচক।
অনলাইনে ভুলের প্রভাব অনেক। তাই ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট আর পেশাদার, দুটির মধ্যে পার্থক্য করতে শিখুন। মনোবিজ্ঞানী হালবার্ট বলেন, আপনি অনলাইনে শুধু নিজেকেই প্রতিনিধিত্ব করেন না, পেশাদার হিসেবে অনেক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। কোনো কিছু পোস্ট করার আগে তার পরিপ্রেক্ষিত ও যারা পাঠক, তাদের বিষয়টি মাথায় রাখবেন। অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যক্তিগত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি অনলাইনে প্রকাশ করা ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি প্রভাবশালী কেউ হলেও বিপদ হতে পারে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করুন কৌশলী হয়ে।
যার সঙ্গে অনলাইনে কথা বলছেন কিংবা বলতে চান, তাকে চিনতে চেষ্টা করুন। সংযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে নিজের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিন। এতে আপনার ব্যক্তিত্ব ঠিক থাকে। অনলাইনে আপনাকে যে কেউ বন্ধুত্বের অনুরোধ (ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট) পাঠাতে পারে, যদি গ্রহণ করতে না চান, তাহলে খুদে বার্তা পাঠিয়ে ‘না’ বলতে শিখুন। ফেসবুকে বন্ধুদের রাখবেন, কিন্তু লিংকডইনের মতো আলাদা প্ল্যাটফর্মে পেশাদার সম্পর্ক গুরুত্ব দিন।
নিজের বন্ধুর সাফল্য কিংবা সহকর্মীর পদোন্নতির পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে আপনার মন খারাপ হয়? নিজের ওপর চাপ বোধ করেন? সে ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীদের পরামর্শ মেনে দেখতে পারেন। এসব পোস্টে লাইক দিলে কিংবা কমেন্ট করলে অনলাইন অ্যালগরিদম আপনাকে সেই ধরনের আরও পোস্ট আর ছবিই বেশি দেখাবে। তাই লাভ, লাইক বাটন সবখানে চাপা যাবে না। কমেন্ট করার ক্ষেত্রেও ভাবুন। চেষ্টা করুন যা আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন, যে মানুষটির পোস্ট সত্যি পছন্দ করেন, তাকে লাইক করতে। এতে আপনার মানসিক শান্তি মিলবে।
নিজের সুস্থতার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেষ্টা করুন। নানা রকম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে, সবখানেই আপনার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অধিকসংখ্যক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকা মানেই অধিক চাপ নেওয়া। অনেক অ্যাকাউন্ট থাকলে আপনাকে বারবার সেগুলো চেক করতে হবে। কার কী বাদ গেল, কে কী করছে, তার জন্য নজরদারি করতে মন চাইবে। আপনার মতামতের জন্যও অনেকেই হয়তো অপেক্ষা করছে। এমন ভাবনা কিন্তু অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। তাই খুব কমসংখ্যক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে চেষ্টা করুন। ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পেশাদার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে পার্থক্য রাখতে হবে। এতে জীবন সহজ হয়।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট