‘আমার বাচ্চা তো খেতেই চায় না’—এই অনুযোগ বহু অভিভাবকের। শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য সুষম পুষ্টি অপরিহার্য। কিন্তু পুষ্টি নিশ্চিত করাটাই হয়ে দাঁড়ায় বিশাল চ্যালেঞ্জ। শিশুকে আদর করে খাওয়ানোর প্রচেষ্টা তো চলেই, আরও চলে শিশুর পিছু পিছু খাবার নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। শিশুকে খাওয়ানো মানে যেন এক যুদ্ধ। মেজাজ বিগড়ে গেলে শিশুকে ধমকও দেন কেউ কেউ। অনেকেই আবার মজার মজার ভিডিও দেখিয়ে শিশুকে খাওয়ান। তাতে বাড়ে মুঠোফোনের প্রতি নির্ভরতা, শিশুর বিকাশের পথে এর নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাও থাকে। এসবের চেয়ে শিশুকে খাবার খাওয়ানোর প্রাণান্ত প্রয়াসে খানিকটা সৃজনশীল পথ বেছে নিতে পারেন। একটু ভিন্নভাবে শিশুকে আগ্রহী করে তুলতে পারেন খাবারের প্রতি।
প্রথম কথা হলো, শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে খাবার খাওয়ার জন্য। বড়দের মতো সময়ের মধ্যে খাবার খেয়ে নেবে শিশু, এমনটা ধরে নেওয়া যাবে না। আপনি হয়তো ভাবছেন, শিশুকে খাইয়ে উঠেই অফিসে ছুটবেন কিংবা সংসারের অন্য কোনো কাজ করবেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে শিশু আপনার মনমতো না-ও খেতে পারে। তাই প্রতি বেলায় এমন কাউকে শিশুর খাবারের দায়িত্বটা নিতে হবে, যাঁর সে বেলায় অমন তাড়া নেই।
সময় নিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, বুঝিয়েশুনিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে শিশুকে। বয়স অনুযায়ী শিশুকে বিভিন্ন খাবারের পুষ্টিগুণও ব্যাখ্যা করতে পারেন। কেবল মায়ের ওপর এত সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে কিন্তু মুশকিল। বরং এই দায়িত্ব পরিবারের সবাই ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন। আর চিপস, চকলেট, প্যাকেটজাত জুস কিংবা কোমল পানীয়র মতো খাবার দিয়ে শিশুর ছোট্ট পেট যাতে ভরে না যায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
সাত রঙের সাত ধরনের সবজি আর ফল সাজিয়ে দিতে পারেন থালায়। শিশুকেও হাত লাগাতে বলতে পারেন এই সাজানোর কাজে। টমেটো, গাজর, বেগুন, নানা রঙের ক্যাপসিকাম, ব্রকলির মতো রঙিন সবজি ছাড়াও মৌসুমি নানা ফল এ কাজে ব্যবহার করতে পারেন। যেসব খাবার কাঁচা খাওয়া যায় না, সেসব সেদ্ধ করে নিতে পারেন। এসব খাবার কাঠিতে গেঁথে সাত রঙের সবজি শাসলিকও করতে পারেন। সাত রঙের সবটাই না পাওয়া গেলে ক্ষতি নেই। কোন রংটা নেই, শিশু খুঁজে বের করুক। ওই রঙের কোনো সবজি বা ফল পাওয়া যায় কি না, তা নিয়েও আলাপ করতে পারেন তার সঙ্গে। সব মিলিয়ে এই রংধনুর সবজি তৈরি এবং খাওয়ার মাঝে শিশু আনন্দ আর পুষ্টি দুই–ই পাবে। তার বিকাশেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে আপনার এমন আয়োজন।
কাস্টার্ডের মতো খাবার তৈরি করতে শিশুকে সঙ্গে নিন। শিশু নিজেই তাতে ছড়িয়ে নিক ফলগুলো। আবার স্বচ্ছ গ্লাসে দই, ফল, বাদাম প্রভৃতি স্তরে স্তরে সাজাতে উৎসাহ দিতে পারেন শিশুকে। নিজের মনের মতো সাজানো খাবারটা খেতে উৎসাহ পাবে সে।
শিশুকে খাবার দিয়ে কিছু একটা তৈরি করতে দিতে পারেন। যেমন আপেল বা আধা সেদ্ধ আলুর পাতলা স্লাইসের মাঝে সে বিভিন্ন আকৃতি সৃষ্টি করতে পারে টুথপিকের সাহায্যে। আপনি গাছের মতো করে ফুলকপি বা ব্রকলি দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন শিশুর বাটির ভাতের ওপর। নাশতার প্লেটে ডিম সেদ্ধ দিয়ে তৈরি করতে পারেন হাসিমুখ। নানা খাবার নানাভাবে সাজিয়ে পরিবেশন করতে পারেন শিশুর আগ্রহ বাড়াতে।
কোনটা কোন খাবার, সেটা না দেখেই বলে দিতে পারার খেলা খেলতে পারেন শিশুর সঙ্গে। চোখ বুজে কেবল স্পর্শ, স্বাদ আর গন্ধ দিয়ে খাবারটাকে চিনে নেওয়াটাই হলো খেলা। এভাবে শিশু নানা ধরনের খাবারের প্রতি আগ্রহী হবে।
যদি ঠান্ডা খাবার খেলে শিশুর তেমন সমস্যা না হয়, তাহলে শিশুর জন্য মাঝেমধ্যে ফলের রস বা দুধ দিয়ে আইসক্রিম তৈরি করে দিতে পারেন বাড়িতে। আইসক্রিমের সব উপকরণ মিশিয়ে একটা ছাঁচে নিয়ে অবশ্য আরও মজাদার কিছু করা যায়। একটা ব্যাগে বরফের টুকরা নিয়ে তার মাঝে ছাঁচটি রেখে ঝাঁকাতে বলতে পারেন শিশুকে। আইসক্রিম বানানোর খেলায় নিজেই ‘বিরাট’ অবদান রাখতে পেরে আনন্দিত হবে সে।
শিশুকে সঙ্গে নিয়ে সবজিবাগান করতে পারেন। নিজের বাগানের সবজি খাওয়ার আনন্দ একেবারেই আলাদা। একটা টবে শিশুকে বীজ বুনতে দিন নিজ হাতে। রোজ সে পানি দেবে সেই টবে। অঙ্কুরোদ্গমের সুখময় দৃশ্যটি তার সতেজ প্রাণে দোলা দেবে। সে প্রাণের স্পন্দনের মর্ম অনুধাবন করতে পারবে। এভাবেই গাছ জন্মায়, ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে, সেই গাছ থেকে আমরা খাবার পাই—এই বোধ থেকেও শিশু খাবারে আগ্রহ খুঁজে পেতে পারে।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট