বহুদিন ধরে এ পথেই আমার চলাচল। পথ চলাটা নিস্তরঙ্গ ছিল ১৪ জুলাই অবধি। সেদিন রাত ১০টার দিকে টিএসসি পেরোই। তখনো চেনা ও প্রাণবন্ত রূপেই ছিল টিএসসি এলাকা। সেই রাত–পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে পুরো দেশের মানুষের জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে। পেশাগত কারণে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতেও প্রায়ই নিয়মিত ঘর থেকে বেরোতে হয়েছে। তবে আমার সেই চেনা পথ হয়ে গেছে অচেনা। সেই সব দিনের থমথমে ভাব কেটে গিয়ে ৫ আগস্ট এই এলাকা একেবারেই ভিন্নরূপে ধরা দিয়েছে, জনতার পদচারণে মুখর হয়েছে আন্দোলনের এই কেন্দ্র। সেই দৃশ্য দেখেছে পুরো দেশ। ৫ আগস্টের পর পেরিয়েছে আরও দুটি দিন। কেমন ছিল এই দুই দিন?
৬ আগস্ট বেলা একটার পর শাহবাগ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাওয়ার পথে দেখলাম, টিএসসির একটু আগে একটি পোড়া গাড়ি পড়ে আছে। টিএসসি দেখে ছোটখাটো একটি মেলা মনে হচ্ছিল। আনন্দের উচ্ছ্বাস বয়ে যাচ্ছিল। টিএসসি পেরিয়ে প্রবেশ করি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভবনে। ছাত্রদের কমনরুমের পাশ দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম। বঙ্গবন্ধু কর্নারে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে থমকে দাঁড়ালাম। মেঝেজুড়ে ছড়িয়ে আছে কাচ। মনে হয় ভাংচুর হয়েছে। সামনে এগোতেই অধ্যক্ষের কক্ষ। দরজাটা বন্ধ। সুনসান হয়ে আছে করিডর। ২০০৯ সাল থেকে এ প্রাঙ্গণে আমার পদচারণ। এমন দৃশ্য দেখিনি কখনো। দোতলার করিডরও গ্রাস করে আছে অন্ধকার।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ আর শাহবাগের মাঝখানের রাস্তায় আনন্দের স্রোত বইছে। ফেরি করা হচ্ছে জাতীয় পতাকা। মোটরসাইকেলের সামনেও লাল-সবুজের বাহার। চলতি পথেও অন্যের সঙ্গে বিজয়ের আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছিলেন উচ্ছ্বসিত মানুষ। শাহবাগ মোড়ে ফিরতে ফিরতে বিজয়মিছিলও দেখা হলো। পথে পোড়া গাড়ির অবশিষ্ট অংশ কেটেকুটে নেওয়ার চেষ্টাও দেখলাম। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে দেয়ালে লেখা আন্দোলনের ভাষা তখনো অভ্যুত্থানের জ্বলজ্বলে প্রমাণ।
এর পরদিন অর্থাৎ আজ (৭ আগস্ট) অবশ্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের রূপ সামান্যই বদলেছে। খানিকটা প্রাণ ফিরে আসতে শুরু করেছে। ওদিকে শহীদ মিনার এলাকা পরিষ্কার করছেন একদল শিক্ষার্থী। কয়েকজন আবার ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গাইছেন শহীদ মিনারের সামনে বসে। পতাকার ফেরি চোখে পড়ল এদিনও। চোখে পড়ল পানি ও সিগারেট ফেরির চিরচেনা দৃশ্য। সাধারণ মানুষ আসছেন। শিশুদের উপস্থিতিও দেখা গেল।
তবে এলাকাটিকে বেশ ঝকঝকে করে ফেলেছেন শিক্ষার্থীরা। টিএসসির দিকে যাওয়ার সময় দেখলাম, দেয়ালগুলোর রূপ ফেরাতে কাজে লেগে পড়েছেন আরেক দল শিক্ষার্থী। টিএসসি এলাকার আবর্জনা সরিয়ে দিচ্ছেন আরেকটি দলের শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ মোড়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন শিক্ষার্থী, আনসার ও বিজিবির সদস্যরা। এক শিক্ষার্থী এগিয়ে এসে সহায়তা করলেন, যাতে নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামে আর যাত্রী ওঠানামা বা রাস্তার অন্যান্য যানবাহন চলাচলে কোনো অসুবিধা না হয়। ৫ আগস্ট–পরবর্তী দুই দিনে দেশটিকে ভালোবেসে, পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষার্থীদের এই সর্বাত্মক প্রচেষ্টার চিত্রটা রয়ে গেল মনজুড়ে।