যে রাঁধে, সে মাছও চাষ করে

নারী–পুরুষ যুক্ত হয়েছেন মাছ ধরার কাজে
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

লম্বাটে পুকুরটার আয়তন প্রায় এক একর। তিন পাড়েই লাগানো হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সবজি। পুকুর আর সবজির সবুজ মিলে একাকার। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভান্ডারপাড়া ইউনিয়নের ওড়াবুনিয়া গ্রামের ওই পুকুরে মাছ চাষ করছেন সুজলা মিস্ত্রিরা। ‘রূপালী মৎস্যচাষি সমিতি’ নামের একটি সংগঠনের আওতায় কাজটা করছেন তাঁরা। ২৫ সদস্যের ওই সংগঠনে ১৩ জনই নারী। সভাপতি সুজলা মিস্ত্রি। পুকুরে একই সঙ্গে বাগদা ও গলদা চিংড়ি এবং রুই-কাতলাসহ বিভিন্ন সাদা মাছ চাষ করা হচ্ছে। এভাবে সমন্বিত মাছ চাষ করার জন্য তাঁদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে উপজেলা মৎস্য কার্যালয়।

শুধু মাছ চাষেই সীমাবদ্ধ নয় সমিতির কার্যক্রম। সমিতির নামে ব্যাংক হিসাব খুলে তাতে টাকা জমা রাখা হচ্ছে। প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে সমিতিতে জমা করছেন সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে ওই টাকা দিয়েই মাছ চাষের কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। পরে সমিতিকে দুই লাখ টাকার মতো আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে।

ডিসেম্বরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাছ ধরার আয়োজন করেছেন সুজলা মিস্ত্রিরা। নারী-পুরুষ যুক্ত হয়েছেন মাছ ধরার কাজে। সবার মধ্যেই ব্যস্ততা। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ। সুজলা মিস্ত্রি বলেন, ২০২২ সালের শুরুতে চার বছরের জন্য ওই পুকুর ইজারা নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছেন তাঁরা। সেদিন তৃতীয়বারের মতো মাছ ধরা হচ্ছে। জানুয়ারি মাসে পুকুর শুকিয়ে ফেলা হবে। তখন সেখানে চাষ করা হবে বোরো ধান। এক জমি থেকে সবজি, মাছ, ধানসহ বিভিন্ন ফসল পাবেন তাঁরা। তাঁদের এভাবে সমন্বিতভাবে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে উপজেলা মৎস্য কার্যালয়। আর আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)।

ঘের থেকে তোলা হচ্ছে চিংড়ি

ওই সমিতির অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারী সদস্যদের সবাই ওই এলাকার গৃহবধূ। এলাকার অধিকাংশ মানুষ মৎস্যজীবী। তবে নারীরা এত দিন শুধু ঘরের কাজই করতেন। অর্থ উপার্জক কোনো কর্মকাণ্ডে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এবারই প্রথম আর্থিক কোনো কাজে যুক্ত হয়েছেন তাঁরা। এতে একদিকে যেমন তাঁরা মাছ চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে শিখতে পারছেন, অন্যদিকে আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন। নিজের দারিদ্র্য ঘোচানোর স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা।

উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ১০টি সংগঠনকে এভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। একইভাবে মাছ চাষ করছেন রুদাঘরা ইউনিয়নের জেলেপাড়ার মুক্তা বিশ্বাসরা। তাঁদের সমিতির নাম ‘রুদাঘরা বাগদা চাষি সিবিও’। ওই সমিতিতেও রয়েছেন ১৩ জন নারী। নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুক্তা বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘স্বামীর টাকার হিসাব দিতে হয়। কিন্তু নিজে উপার্জন করলে হিসাব দিতে হবে না। নিজের আয়ের টাকা ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারব। সেই সঙ্গে সঞ্চয়ও করতে পারব।’

সমিতির আরেক সদস্য স্বপ্না রানী বলেন, ‘শোলগাতিয়া এলাকায় হাজারের বেশি চিংড়িঘের আছে। কিন্তু এই প্রথম নারীরা একটি ঘের করেছেন। সফল হতে পেরে ভালো লাগছে। নিজেরা এখন বেশ স্বাবলম্বী।’

ডুমুরিয়া উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। আগের মতো বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি আর শীত মৌসুমে শীতের প্রভাব নেই। ওই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নারীদের মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এভাবে সমিতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাছ চাষ করার ফলে নারীদের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ছে। আর্থিকভাবেও সচ্ছলতা আসছে। নারীদের মাধ্যমে মাছ চাষের ওই কার্যক্রম অন্যান্য ইউনিয়নেও ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।