দেশের ভূমিজ সম্প্রদায়ের প্রথম স্নাতক তিনি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এতটা পথ এসেও শেষ হয়নি সংগ্রাম। স্নাতকোত্তরের ক্লাস ফেলে বাড়ি এসেছেন ধান কাটতে। মা-বাবার সঙ্গে কাটা–মাড়াই শেষ করে তবেই ফিরে যাবেন ক্যাম্পাসে। অঞ্জন ভূমিজের জীবনযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছেন কল্যাণ প্রসূন
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে ফুলতলা চা-বাগান। এই বাগানের এলবিনটিলা ফাঁড়ির ছোট একটি টিলার ওপর অঞ্জনদের বাড়ি। আসলে বাড়ি বলতে টিনের চালা দেওয়া মাটির একটি ঘর। তাঁর বাবা অমৃত ভূমিজ এই চা-বাগানের শ্রমিক। মা রতনমনি ভূমিজও একই কাজ করতেন। এখন চা-বাগানের কাজ ছেড়ে স্থানীয় খাসিয়াপুঞ্জিতে দিনমজুরির কাজ করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে অঞ্জন সবার বড়। ছোট দুই বোনও লেখাপড়া করছেন। দরিদ্র এই পরিবার থেকে উঠে গিয়েই মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে পড়েছেন অঞ্জন। গত সেপ্টেম্বরে কালো গাউন পরে সমাবর্তনের টুপি উড়িয়েছেন। মা-বাবাকেও ক্যাম্পাসে নিয়ে গিয়েছিলেন আনন্দের মুহূর্তে সঙ্গী করতে। মা-বাবার সঙ্গে তোলা সেসব ছবি নিয়েই অঞ্জনের সঙ্গে কথার শুরু হয়েছিল। তারপর বাড়ির ছোট উঠানটায় বসে সেই আলাপ চলল তাঁর জীবনের মোড়ে মোড়ে ঘুরে।
অঞ্জনদের বাড়ির কাছেই পশ্চিম বটুলি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই স্কুলেই দুই সন্তানকে ভর্তি করিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন নিবারণ নামের অঞ্জনের এক জেঠা। সমবয়সী দুজনকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাচ্ছেন, দেখে অঞ্জনকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেন তাঁর মা রতনমনি ভূমিজ।
সেই শুরু। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় করে অঞ্জন বড় হতে থাকলেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে দেখা গেল তাঁর সঙ্গে ভর্তি হওয়া চা-বাগানের অনেক ছেলেমেয়েই ঝরে পড়েছে।
প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ফুলতলা বশির উল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন অঞ্জন। ছুটির দিনগুলোতে মায়ের সঙ্গে খাসিয়াপল্লিতে যান। দৈনিক ৩০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। এভাবেই পড়াশোনা এগিয়ে নিচ্ছিলেন। নবম শ্রেণিতে বিভাগ নির্বাচনের সময় খুব মন খারাপ হলো অঞ্জনের। সেভেন-এইটে পড়ার সময় দেখতেন, বিজ্ঞান বিভাগের ছেলেমেয়েরা ল্যাবে কাজ করেন। তাঁরও খুব ইচ্ছা হতো ব্যবহারিক ক্লাস করতে। সেই ইচ্ছা থেকেই বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির আগ্রহ তাঁর। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকেরা পরামর্শ দিলেন মানবিক শাখায় পড়তে। কারণ, বিজ্ঞানের বিষয়গুলো কঠিন, প্রাইভেট পড়তে হবে। এত টাকাপয়সা কি অঞ্জনের পরিবার দিতে পারবে?
অঞ্জন সিদ্ধান্ত নিলেন, পড়লে তিনি বিজ্ঞান নিয়েই পড়বেন। হলোও তা-ই। কিন্তু নিজে নিজে আর কতটা পড়বেন। পদার্থ-রসায়নের অনেক কিছুই বুঝতে পারেন না। একবার রসায়নে ৫০ নম্বরের মধ্যে পেলেন ২। প্রধান শিক্ষক রেগেমেগে অঞ্জনকে ডেকে বললেন বিজ্ঞান বিভাগ বাদ দিতে। অনড় রইলেন অঞ্জন। হতাশ না হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিলেন। এসএসসির ফল প্রকাশ হলো, পেলেন জিপিএ ৪ দশমিক ১৩।
এসএসসির পর জুড়ীর তৈয়বুন্নেছা খানম একাডেমি সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখানেও বিজ্ঞানে পড়তে শিক্ষকদের বাধা এল। অঞ্জন বিজ্ঞান বিভাগেই ভর্তি হলেন। বাসা থেকে কলেজ দূরে। থাকেন বিভিন্ন চা-বাগানের আত্মীয়দের বাসায়। প্রতি সপ্তাহে বাসা থেকে চাল ও সবজি নিয়ে যান। তাঁর বাবা এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ নিলেন। সেই টাকায় বিজ্ঞানের বিষয়গুলো প্রাইভেট পড়লেন। ২০১৬ সালে এইচএসসি পাস করলেন জিপিএ ৩ দশমিক ৯২ পেয়ে।
এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। অঞ্জন চলে গেলেন সিলেটের খাদিম চা–বাগানে তাঁর এক মাসির বাসায়। সেখান থেকেই ভর্তি কোচিং শুরু করলেন। তারপর একে একে নয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করলেন। অংশ নিলেন পরীক্ষায়। কিন্তু একটিতেও ভর্তির সুযোগ পেলেন না। ভেঙে পড়লেন।
অঞ্জনের মা-বাবা সান্ত্বনা দিলেন। তাঁর বাবা সাহস দিয়ে বললেন, ‘তুই চিন্তা করিস না, চেষ্টা করে যা। ভিক্ষা করে হলেও তোকে পড়াব।’
এই কথায় মনে জোর পেলেন অঞ্জন। ২০১৭ সালে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলেন। তার মধ্যে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সি ইউনিটে মেধাতালিকায় প্রথম হলেন। বেছে নিলেন পদার্থবিজ্ঞান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে পারিবারিক দুরবস্থার কথা তুলে ধরলেন অঞ্জন ভূমিজ। শিক্ষকেরা চাঁদা তুলে ভর্তির টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। শুরু হলো অঞ্জনের নতুন জীবন।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিক্ষক ও সচ্ছল পরিবারের সহপাঠীরা প্রায়ই অঞ্জনকে সহযোগিতা করেছেন। মাঝখানে কয়েকটা টিউশনি করিয়েছেন তিনি। কিন্তু চা–শ্রমিকের সন্তান বলে অভিভাবকেরা একসময় সন্তান পড়ানো বন্ধ করে দেন। করোনার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে খাবার ডেলিভারির কাজ করেছেন। ক্যাম্পাসের বাইরের রেস্তোরাঁ থেকে হলে খাবার পৌঁছে দিয়ে দৈনিক ১০০ টাকা পেতেন। বাড়িতে এলেই খাসিয়াপুঞ্জিতে মায়ের সঙ্গে যেতেন কাজে। নিজেদের জমিতে ধানের চারা রোপণ, ধান কাটার কাজও করতেন।
২০২২ সালে অঞ্জনের পাশে দাঁড়ান তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থী। অঞ্জনকে তিনি প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেন। এই অর্থ পেয়ে এখন পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হয়েছেন অঞ্জন।
চা-বাগানের শ্রমিক পরিবার হিসেবে অঞ্জনরা চাষাবাদের জন্য ৪০ শতাংশ (এক বিঘার একটু বেশি) জমি বরাদ্দ পেয়েছেন। এর সঙ্গে দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়েছেন। সেই জমির পাকা ধান কাটতেই বাড়িতে ছুটে আসেন অঞ্জন। বলছিলেন, ‘একজন শ্রমিকের মজুরি ৫০০-৬০০ টাকা। কয়েকজন শ্রমিক লাগবে ধান কাটতে। এত টাকা কই পাব? তাই নিজেই কাজ করছি।’
২ ডিসেম্বর থেকে অঞ্জনের স্নাতকোত্তরের ক্লাস শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ধান কাটার কাজও শেষ করে ফেলেছেন। আজ ১৬ ডিসেম্বর তাঁর ক্যাম্পাসে ফেরার কথা। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে পরিবারের হাল ধরতে চান অঞ্জন, ‘মা-বাবা আর কত দিনই–বা কাজ করতে পারবেন। মাস্টার্স শেষ করে একটা চাকরি খুঁজব। ছোট দুই বোনের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করতে হবে। ভূমিজ সম্প্রদায়ের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী প্রাথমিক-মাধ্যমিকে পড়ার সময় ঝরে পড়ে। অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াব।’