আমি চঞ্চল চৌধুরীর ‘মেয়ে’

চঞ্চল চৌধুরী ও তাঁর ছেলে শুদ্ধের সঙ্গে সুপ্রিয়া
ছবি: সংগৃহীত

বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে আসো—তিন শব্দের ছোট্ট একটি খুদেবার্তা। সেটা পড়েই আমি মুঠোফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছি। চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে চার বছর ধরে ই-মেইলে, মুঠোফোনে, মেসেঞ্জারে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। কত শব্দ, কত বাক্যের আদান-প্রদান। কিন্তু আজকের এই বাক্যটির ভেতর যেন অন্য রকম আনন্দ লুকিয়ে আছে। একছুটে চলে গেলাম বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে। হ্যাঁ, চঞ্চল চৌধুরী এসেছেন। তাঁকে দেখে আমি আনন্দে হাসব, না কাঁদব—বুঝতে পারছি না। বোধ হয় তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পারলেন। আমাকে কাছে টেনে নিলেন। তাঁর মুখে ফুটল সেই চিরচেনা হাসি।

এই বিখ্যাত মানুষটি আমার মোরাল প্যারেন্ট বা নৈতিক অভিভাবক। আরও সহজ করে বললে, নৈতিক বাবা। আমি তাঁর মোরাল চাইল্ড বা নৈতিক সন্তান। তিনি আমার মেডিকেল পড়াশোনায় শুরু থেকে সহায়তা করে যাচ্ছেন। কীভাবে শুরু, সেই গল্প পরে বলছি। তার আগে বলি, ৫ ডিসেম্বর তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রসঙ্গটি।

চঞ্চল চৌধুরীর স্ত্রী ডা. শান্তা চৌধুরী। মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। তিনি সেদিন আমাদের ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে এক্সটারনাল হিসেবে ভাইভা নিতে আসেন। খবরটা জানতে পেরে চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বললাম, আমি ম্যামের সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি ফোন নম্বর দিয়ে দেখা করতে বললেন। দেখা হলো। শান্তা চৌধুরী ভাইভা নেওয়ার ফাঁকে অনেকক্ষণ ধরে আমার সঙ্গে কথা বললেন। কথাবার্তা শেষ করে আমি চলে আসি রুমে। এর কিছুক্ষণ পরই স্যারের (চঞ্চল চৌধুরীকে আমি স্যার বলেই সম্বোধন করি) সেই খুদেবার্তা। আমি তখনো বুঝতেই পারিনি, কিছুক্ষণ পরে কী ঘটতে চলেছে!

চঞ্চল চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে সুপ্রিয়া, সঙ্গে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ

যা হোক, চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, কাউকে যেন কিছু না জানাই। এটি একান্তই ব্যক্তিগত সফর। তিনি তাঁর স্ত্রীকে এগিয়ে নিতে এবং সেই সঙ্গে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। আমার চোখে প্রায় পানি চলে আসার মতো অবস্থা। সঙ্গে ছেলে শুদ্ধকেও এনেছেন। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে শুদ্ধকে বললেন, ‘এ হচ্ছে তোমার দিদি’। শুদ্ধ প্রথমে কিছুটা দ্বিধান্বিত থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সঙ্গে বেশ ভাব হলো। আমি ওকে ছোট ভাইয়ের মতো আপন করে নিলাম। মনে হচ্ছিল, এ যেন আমার পরিবার। আমাকে আমার পরিবারের লোকজন দেখতে এসেছে!

অধ্যক্ষের কক্ষে আলাপ হচ্ছে। আমাদের অনেক শিক্ষক আছেন। চঞ্চল চৌধুরীর এত গোপন উপস্থিতিও টের পেয়ে গেছেন বেশ কিছু শিক্ষার্থী। তাঁরাও চলে এসেছেন। একপর্যায়ে অধ্যক্ষ স্যার চঞ্চল চৌধুরীকে অনুরোধ করলেন একটা গান গাইতে। গান ধরতে যাবেন, এমন সময় তাঁর মনে হলো, মুহূর্তটা ভিডিও করে রাখলে মন্দ হয় না। কিন্তু চঞ্চল চৌধুরীর ফোন হাতে নিয়ে ভিডিও করবে কে? কে আবার, আমার মেয়ে সুপ্রিয়া—সমাধান বাতলে দিলেন তিনিই। সবাই চমকে তাকাল আমার দিকে। আমি তাঁর মোরাল চাইল্ড—এই তথ্যটা তখনো জানেন না কেউ। চঞ্চল চৌধুরী সরাসরি আমাকে মেয়ে বলে নাম ধরে সম্বোধন করায় মুহূর্তেই যেন আমার ভেতর থেকে সব সংকোচ, সব হীনম্মন্যতা কেটে গেল।

এই সংকোচের কথা বলতে গেলে একটু পেছন ফিরে যেতে হবে। ২০১৯ সালের কথা। সে বছর মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাই আমি। এই খবরে সবাই যখন খুশিতে আত্মহারা, আমি তখন ভর্তির টাকা জোগাড় করার চিন্তায় অস্থির। কীভাবে থাকা–খাওয়ার খরচ জোগাড় করব, কীভাবে মেডিকেল পড়ার খরচ চালাব—দুশ্চিন্তায় দিশাহারা অবস্থা আমার। এমন সময় মোরাল প্যারেন্টিং ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ড. মাহবুব স্যারের খোঁজ পেলাম। তাঁর মাধ্যমে চঞ্চল চৌধুরী আমার নৈতিক অভিভাবকত্ব গ্রহণ করলেন।

এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রতি দুই মাস পরপর বৃত্তির টাকা যথাসময়ে আমার হাতে চলে এসেছে। এই বৃত্তিটা আমার কাছে পরম এক নির্ভরতা। এই বৃত্তির কারণে আমার থাকা–খাওয়ার খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। আমি ঠিকমতো পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পেরেছি। আসলে আমাদের মতো যাঁরা যুদ্ধ করে পড়াশোনা চালিয়ে যান, তাঁদের জন্য একজন মোরাল প্যারেন্ট মানে দুশ্চিন্তাহীন আশ্রয়ের নাম। যেখানে আশ্রয় না পেলে মেডিকেল পড়াশোনা হয়তো আদৌ শেষ করতে পারতাম না।

এখন এমবিবিএস শেষ বর্ষে পড়ছি। চঞ্চল চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর অভিভাবকত্বে চিকিৎসক হওয়ার পথে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি আমি। চার বছর হয়ে গেছে। কেবল আর্থিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও যে কতটা পাশে থেকেছেন আমার এই মা–বাবা, তা বলে শেষ করা যাবে না। এই তো সেদিনের আলাপের একফাঁকে যখন আমি শান্তা ম্যামকে বৃত্তির জন্য ধন্যবাদ জানাতে যাচ্ছিলাম, তিনি কেমন আদর করে বললেন, ‘এভাবে কেন বলছ, সুপ্রিয়া! এসব একদম ভাববে না। তুমি মেধাবী বলেই সরকারি মেডিকেলে পড়ছ।’ হ্যাঁ, আমার সংকোচ, বিব্রতবোধ কেটে গিয়েছে তখনই। এরপর চঞ্চল চৌধুরী নিজের মেয়ে সম্বোধন করলেন, শুদ্ধর দিদি বলে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর তো আমার নিজের আর কিছু চাওয়ার নেই!

সেদিন তাঁদের বিদায়ের সময় মনে হচ্ছিল, পরিবারের মানুষদেরই বিদায় দিচ্ছি। কষ্ট হচ্ছিল। আমার সেলিব্রেটি অভিভাবক ক্যাম্পাসে এসে যেন আমাকেও সেলিব্রিটি বানিয়ে দিয়ে গেলেন। এখন সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে—চঞ্চল চৌধুরী আমার কী হন! আমি কী করে ওদের বোঝাই, উনি আমার বাবা, আমি যে ওনার মেয়ে হই!

(অনুলিখিত)