সন্তানকে কি জানাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা?

আমাদের অস্তিত্ব আর জীবনযাপনের ভাঁজে ভাঁজে  নানাভাবে মিশে আছে একাত্তর। যুদ্ধদিনের সেই উদ্যম থেকে প্রতিনিয়ত আমরা পাই এগিয়ে চলার প্রেরণা। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে যায় মুক্তিযুদ্ধের শিখা অনির্বাণ।

নকশার আয়োজনে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে মা ত্রপা মজুমদার মেয়ে আত্রেয়ী আহসানকে শোনালেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প

‘এই জানালাটা দেখে তোমার কী মনে হয়?’

শেষ হেমন্তের কোমলতাকে পুরোপুরি ঢেকে দিয়েছে তখন তীব্র সূর্য। খাঁ খাঁ করছে দুপুর। এর মধ্যেই রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিস্তম্ভটির খোলা জানালাটি দেখিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞাস করলেন মা। প্রশ্ন শুনে কিশোরী মেয়ের চোখেমুখে লেপ্টে থাকা জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল যেন আরও বড় হয়ে দুপুরের মতো বিস্তৃত হয়ে গেল। স্থপতি ফরিদ ইউ আহমেদ ও জামি আল শাফির নকশায় নির্মিত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের নকশার মূল ব্যাখ্যায় যা-ই থাক না কেন, মা যখন মেয়েকে মুক্তিযুদ্ধের এই নিদর্শন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, তখন এর ব্যাখ্যাও তিনি দিলেন নিজের মতো করে। যুদ্ধদিনের গৌরবগাথা বলতে বলতে মেয়েকে বললেন, ‘আমার মনে হয়, মা, এই জানালা হলো ভবিষ্যৎ। জানালাটা দিয়ে এখন আমাদের সম্ভাবনার দিকে তাকাতে হবে। আর এই যে প্রাচীর, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আমাদের ওপর যে নির্মম নির্যাতন আর গণহত্যা চালিয়েছিল, এটা তার প্রতীক। তবে একাত্তরের এসব ক্ষত বুকে নিয়েই আমাদের এখন ওই জানালা দিয়ে সামনের দিকে তাকাতে হবে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সুন্দর আগামীর কথা ভেবে।’

মা-বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন ত্রপা, মেয়ে আত্রেয়ীকেও বলছিলেন সেই গল্প।

মেয়ে আত্রেয়ী আহসানকে এসব কথা বলছিলেন মা ত্রপা মজুমদার। মঞ্চ ও টেলিভিশনের চৌকস অভিনেত্রী তিনি। আরেক পরিচয়ে তিনি শিক্ষকও—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক। সেই ‘শিক্ষক’ মায়ের ১৭ বছর বয়সী চুপচাপ মেয়ে আত্রেয়ী। পারিবারিক পরিমণ্ডলে আরও একটি নাম আছে তার—ইচ্ছা। পড়ে সানবিমস স্কুলে। দশম শ্রেণিতে পড়া এই মেয়ে যখন মায়ের কথাগুলো একমনে শুনছিল, তখন কি তার মনে ভাসছিল তার নানা শহীদ মুনীর চৌধুরীর কথা? ত্রপার মা অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদারের বড় ভাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। একাত্তরের ডিসেম্বরে আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাঁকেও হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এ স্থান ছিল লাশে ঠাসা। সেখান থেকে অনেকের লাশই আর শনাক্ত করা যায়নি। মুনীর চৌধুরীকে হত্যার পর তাঁর মৃতদেহ কি এখানে ফেলে রাখা হয়েছিল?

মিরপুরের ‘জল্লাদখানা’র সেই কুয়া, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মানুষকে হত্যার পর যেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল।

আমরা জানি না। জানেন না ত্রপারাও। তবে তাতে সমস্যা কী, মুনির চৌধুরী তো জীবনের অধিক জীবন্ত তাঁদের পরিবারে, আমাদের হৃদয়ে।

ত্রপা মজুমদারের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে। পরিবারের মধ্যে মা-বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে তাঁর বড় হওয়া। এভাবেই একাত্তরের পরম্পরা বহন করে চলেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হচ্ছে বটে, কিন্তু তা কি আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে উঠতে পেরেছে? ত্রপা আর আত্রেয়ীকে সঙ্গে নিয়ে ১১ ডিসেম্বর আমরা যখন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি নিদর্শন দেখতে গেলাম, প্রশ্নটি সে সময় করা হলো ত্রপাকে।

রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে মা–মেয়ে

আমাদের গাড়িটি চলেছে মিরপুরের সেই ‘জল্লাদখানা’র দিকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন ওয়াসার এই পাম্পহাউসে গণহত্যা হয়েছিল ঢের, পরে সেখানে পাওয়া গিয়েছিল ৭০টি মাথার খুলি ও ৫ হাজার ৩৯২টি অস্থিখণ্ড। এখানে ছিল একটি কুয়া। হত্যার পর ওই কুয়ায় ফেলে রাখা হয়েছিল অনেককে। যুদ্ধের সময় এটি তাই ‘জল্লাদখানা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। মেয়ের সঙ্গে ত্রপার এখানে প্রথম আসা। যেতে যেতেই প্রশ্নটির জবাব বাতলালেন তিনি, ‘মুক্তিযুদ্ধ এখন অনেক বেশি দিবসকেন্দ্রিক আর আনুষ্ঠানিকতার বিষয় হয়ে উঠেছে। অনুভবের জায়গাটা কমে গেছে।’

মায়ের এ কথার পর নিশ্চুপ আত্রেয়ীর গলায়ও কথা ফুটল, ‘মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে বারবার শুধু অতীতের কথা বলা হয়। সামনের দিকেও তাকানো দরকার।’

মিরপুরের ‘জল্লাদখানা’য় মা–মেয়ে ঘুরে দেখছেন মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একাত্তরের জল্লাদখানাটি বর্তমানে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা যখন সেখানে, সেই কুয়ার সামনে এসে দাঁড়ালাম, কেমন যে এক অনুভূতি ছড়িয়ে গেল শরীরের মধ্যে! গভীর মমতায় ত্রপা ছুঁয়ে দেখছিলেন কুয়াটি। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে গল্পচ্ছলে বললেন, ‘দেখো, একটা কুয়া গোটা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে দিচ্ছে। একাত্তরে কী ঘটেছে, তা বলে দিচ্ছে।’

মায়ের কথা শুনতে শুনতে মেয়ে এবার তাকাল চারপাশে। ‘এখানে কী ঘটেছিল’ নামের যে ঘরে কুয়াটি রয়েছে, তার চারদিকের দেয়ালে অজস্র নাম—খন্দকার আবু তালেব, আবদুল হাকিম, আবদুর রহমান...সবাই-ই একাত্তরের শহীদ।

চারদিকের দেয়ালে অজস্র নাম—খন্দকার আবু তালেব, আবদুল হাকিম, আবদুর রহমান...সবাই-ই একাত্তরের শহীদ

এর মধ্যে আরও কয়েক দর্শনার্থীর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল। তাঁদেরই একজন মিরপুরের মোহাম্মদ আবদুর রশিদ। সুইজারল্যান্ডপ্রবাসী নাতনি সুপ্রিয়াকে নিয়ে এসেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাস করলাম, ‘কেন এসেছেন?’ বয়স্ক ভদ্রলোকের সহজ উত্তর, ‘আমার পরের প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে, যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুভব করতে পারে।’

মেয়েকে নিয়ে ত্রপাও তো সে কারণেই এসেছেন। এ জাদুঘরের ঘরে ও বাইরের অংশে ঘুরতে ঘুরতে বারবার মেয়েকে কিছু না কিছু বোঝাচ্ছিলেন তিনি। যেমন বাইরের দেয়ালের একটি ম্যুরাল দেখিয়ে তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘ইচ্ছা, এখানে দেখো সূর্য আর তার নিচে লুটিয়ে পড়া মানুষের ছবি। লুটিয়ে পড়া মানুষগুলো হলো আমাদের আত্মত্যাগের চিহ্ন, আর সূর্যটা বলছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কথা।’ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কতভাবেই না ব্যাখ্যা করা যায়!

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেন বয়ে চলে বহমান নদীর মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এমনটাই ভাবনা এই মায়ের

যুদ্ধের স্মারক নিদর্শনগুলো ঘুরতে ঘুরতে কথা প্রসঙ্গে ত্রপা বলছিলেন, ‘১৯৭১ সালে আমার মা একটি ডায়েরি লিখেছিলেন। সেখানে আছে আগরতলায় তাঁদের উদ্বাস্তুজীবনের কথা, লেখা আছে মা যখন মুনীর মামার হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পেলেন, তখন তাঁর কেমন লাগছিল, সেসব কথাও। বড় হয়ে আমি যখন ডায়েরিটা পড়ি, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধকে ঘিরে বিভিন্ন পরিবারের কষ্টকর অভিজ্ঞতাগুলো সে সময় আরও প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে পেরেছি।’

আর এখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যুদ্ধদিনের সেই আত্মত্যাগ ও ভয়াবহতার চিহ্নগুলো স্পর্শ করে রক্তে লেখা অধ্যায়টি ত্রপা যে সময় আত্রেয়ীকে বোঝাচ্ছেন, মেয়ের সামনে উন্মোচন করছেন বাঙালির সু–উচ্চ গৌরবের খেরোখাতা, তখন মেয়ের সামনে তিনি কি নিজেই হয়ে উঠছেন না একটি ডায়েরি?

এসব জীবন্ত দিনপঞ্জির পরম্পরাই তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বয়ে চলেছে বহমান নদীর মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।