একটা সময় তরুণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতিবিমুখ বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। আধুনিক রাজনৈতিক পরিবেশ, বৈশ্বিক ইস্যু এবং সমাজের পরিবর্তনশীল বাস্তবতা তরুণদের মধ্যে রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে আগ্রহ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং গণতন্ত্রের সংকট তাঁদের রাজনীতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে উৎসাহিত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘সরকার ও রাজনীতি’ বা ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ ধরনের বিষয়ে অনেক শিক্ষার্থীরই আগ্রহ জাগতে পারে।
সরকার ও রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীরা শুধু রাজনৈতিক তত্ত্বের ওপরই নয়; রাষ্ট্রের কাঠামো, ক্ষমতার ব্যবহার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, গণতন্ত্রের প্রক্রিয়া, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিতভাবে পড়াশোনা করেন। এখানে পড়ানো হয় কীভাবে সরকার ও রাষ্ট্র কাজ করে, কূটনীতির ভূমিকা কী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার কার্যক্রম। কিন্তু এ বিষয় সরাসরি মাঠের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যাঁরা মনে করেন ভবিষ্যতে রাজনীতিবিদ হবেন বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়বেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত যে মাঠের রাজনীতি ও একাডেমিক রাজনীতির মধ্যে তাত্ত্বিক ও বাস্তবতার এক বিস্তৃত ব্যবধান রয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে দেশের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সরকার ও রাজনীতিবিষয়ক বিভিন্ন কোর্স পড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এ বিষয়ে প্রচুর সুযোগ রয়েছে। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন ইত্যাদি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বমানের গবেষণা ও শিক্ষার সুযোগ প্রদান করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চতর গবেষণার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। পিএইচডি বা মাস্টার্স পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিক তত্ত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নীতিনির্ধারণ নিয়ে গভীর গবেষণা করতে পারেন। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকট মোকাবিলার জন্য এ বিষয়ে গবেষণার চাহিদা ক্রমে বাড়ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে কী হবে—এ নিয়ে অনেকের মনেই নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। তবে আমি মনে করি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মজীবন শুরু করতে পারেন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, জননীতি বিশ্লেষণ, সাংবাদিকতা, গবেষণা ও শিক্ষা খাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতেও চাকরির সুযোগ আছে। বিশেষ করে বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকট ও সামাজিক পরিবর্তনের সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় অবদান রাখতে পারেন।
যাঁরা রাষ্ট্রের কাঠামো, ক্ষমতা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং সমাজের গভীর বিশ্লেষণ নিয়ে চিন্তা করতে আগ্রহী, তাঁদের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান আদর্শ বিষয়। যাঁরা বিশ্লেষণধর্মী কাজ, গবেষণা, নীতিনির্ধারণ বা কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী, তাঁরা এ বিষয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে পারেন। তবে শুধু মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়টি অপরিহার্য নয়।
বিশ্বব্যাপী রাজনীতির গতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা রাজনীতিবিজ্ঞানকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতার কাঠামো ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে উঠছে। ফলে ভবিষ্যতে এ বিষয়ের গুরুত্ব ও চাহিদা আরও বাড়বে বলে আমি মনে করি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা রাজনীতিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা এখন শুধু শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক জ্ঞান বাড়ানোর একটি উপায় নয়; বরং সমাজের পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় তাঁদের নীতিনির্ধারণ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতায় সমৃদ্ধ করতে পারে। এর মাধ্যমে তাঁরা শুধু ক্যারিয়ার গড়তে নয়; বরং সমাজের উন্নয়নে এবং বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক