সাধারণ সময়েও গমগম করত বাড়িটা আর ঈদ হলে তো কথাই নেই। লোকসংগীত সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের স্মৃতিধন্য হীরামন মঞ্জিলে ঈদ কেমন ছিল, পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন শিল্পীর তৃতীয় প্রজন্ম ড. নাশিদ কামাল
আমার দাদা আব্বাসউদ্দীনের কারণে ‘হীরামন মঞ্জিল’কে কমবেশি সবাই চিনতেন। পুরানা পল্টনের সেই বাড়িকে এ অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক আড্ডাখানাও বলা যায়। যেহেতু সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের খুব কম পরিবারই গানবাজনা, নাচ বা অভিনয়ে যুক্ত ছিল, তাই আমাদের বাড়িটি ঘিরে মানুষের কৌতূহল ছিল।
আমার জন্মের পরের বছরই দাদা মারা যান, তাই আমার ঈদের স্মৃতিতে দাদার চেয়ে দাদি লুৎফুন্নেসা আব্বাস আছেন অনেকটা জায়গাজুড়ে। আমার বাবা সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল ছিলেন আব্বাসউদ্দীনের বড় ছেলে। আমার চাচা মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফুফু ফেরদৌসী রহমানও তখন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী।
ঈদের সময়ে আমাদের বাড়িতে মানুষের হাট বসে যেত। জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে কামরুল হাসানের মতো অনেক মানুষ আসতেন। আমার দাদারা চার ভাই ও এক বোন ছিলেন। ঈদে তাঁরাও আসতেন পরিবার নিয়ে। দাদি লুৎফুন্নেসা তাঁদের সঙ্গে মিলে রান্নাবান্না করতেন। কত রকম মুখরোচক খাবার যে রান্না হতো! সে সময় আমি খুবই ছোট, বয়স চার–পাঁচ বছর হবে।
আমার চাচা, চাচি, কাজিনরা মিলে দারুণ আনন্দে কাটত ঈদের সকাল। বাড়ির সবাই মিলে আলোচনা করে ঈদের দুপুরের মেনু ঠিক করা হতো। নিজেরা আলোচনার পর কী কী বাজার লাগবে, জানতে বাবুর্চিকে ডাকা হতো। রান্নার সময় হাত লাগাতেন রংপুর ও কোচবিহার থেকে আসা অনেকে। তাঁরা সহজাত শিল্পী, তাই রান্না করতে করতেই গান গাইতেন। আমার খুব ভালো লাগত এমন পরিবেশ। খাওয়ার পর কোনো আত্মীয় অসুস্থ থাকলে দাদিরা তাঁকে দেখতে যেতেন স্কুটারে চেপে।
সকালবেলা আরেকটা নিয়ম ছিল। সকালে উঠে গোসল করে আমরা তৈরি হতাম ঈদের নামাজ পড়তে যাব বলে। ছোট ছোট শীতলপাটি নিয়ে বাবা–চাচার সঙ্গে আমরা তিন বোন ও চাচাতো বোনেরা মিলে বায়তুল মোকাররমে যেতাম।
ফিরেই দেখতাম, নানা–নানি চলে এসেছেন। আমার নানা ছিলেন হাফিজুর রহমান, যিনি বাণিজ্য মন্ত্রীও ছিলেন। নানি দারুণ এসরাজ বাজাতেন, খুব ভালো রান্না করতেন। নানু খুব ভালো ডালপুরি বানাতেন। ঈদের দিন সকালে সেই ডালপুরি বানিয়ে নিয়ে আসতেন তাঁরা। আমরা একসঙ্গে বসে নাশতা করতাম। আর দাদি হয়তো খাসি–মুরগি রান্না করতেন। সবাই মিলে ডালপুরি দিয়ে সেই খাসি–মুরগি খেতাম।
যুদ্ধের পরের বছর ঈদে সকালের নাশতা খেয়ে একটা সময় আমি বাবা ও চাচার সঙ্গে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতাম। এক ফাঁকে তাঁর সঙ্গে দরকারি কথাও সেরে নিতেন আব্বা ও চাচা। বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলতেন, ‘তোর আব্বার যে রেকর্ডগুলো এইচএমভিতে আছে, সেগুলো নিয়ে আয়। উকালতি ফেলে তোকেই যেতে হবে।’ দাদার নামে একটা ইনস্টিটিউট করার কথা বলতেন। আমি এ সময় বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়েছি। একবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছি, তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘দাদার নাম রাখবি কিন্তু।’
বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে একসময় বাসায় ফিরতাম। ততক্ষণে মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে অনেক মানুষ চলে এসেছেন। সারা বছর নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন বাবা আর মা (হোসনে আরা কামাল) ব্যস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক। তাই ঈদের সময়েই মানুষ তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তাঁদের সঙ্গে আসা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হতো।
দুপুরের পর আমরা যেতাম নানাবাড়ি সেগুনবাগিচায়। সেখানেও দারুণ আনন্দে কাটত সময়টা।
ঈদের দ্বিতীয় দিন সাধারণত আমরা যেতাম আব্বা–আম্মার বন্ধুদের বাড়ি। আমার বয়স যখন ছয় বছর, আব্বা তখন গাড়ি কেনেন। সেই গাড়ি চালিয়ে আমাদের সেসব বাড়ি নিয়ে যেতেন আব্বা। আমরা বেড়ানোটা তখন খুবই উপভোগ করতাম। কারণ, বয়সে ছোট হলেও তখন পড়াশোনা, রেওয়াজ, টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ে আমিও খুবই ব্যস্ত থাকতাম। ঈদের কটা দিন যেন মুক্ত পাখি। স্বাধীনতার পর তো বঙ্গভবনে যেসব রাষ্ট্রীয় অতিথি আসতেন, তাঁদের অনুষ্ঠানগুলো ইংরেজিতে আমিই পরিচালনা করতাম। অনেক সময় ঈদের দিনেও ডাক আসত আর আমাকে বেরিয়ে পড়তে হতো। ফলে মা–বাবার মতো না হলেও আমারও সারাটা বছর খানিকটা ব্যস্ততাতেই কাটত।
ঈদের দু–এক দিন আগে মাঝেমধ্যে ফুফু (ফেরদৌসী রহমান) চলে আসতেন। আমাদের সব বোনকে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় কিনে দিতেন। কাপড় সেলাইও করে দিতেন ফুফু। অনেক সময় দরজির কাছে কাপড় সেলাই করতে দিতেন মা–বাবা। সেই কাপড়ের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হাতে পেতাম ঈদের আগের দিন।
ঈদের চাঁদ নিয়েও কত মজার স্মৃতি। রমজানের শেষ দিন আমরা ছাদে উঠতাম। চাঁদ খুঁজতে আশপাশের ছাদেও লোকজন উঠতেন। অনেকে আমাদের বাসায়ও চলে আসতেন।
চাঁদ উঠলে আমার চাচা ছাদে পাটি পেতে আমাদের নিয়ে বসতেন। হারমোনিয়ামের সুরে সুরে গাইতেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।’ চাচার সঙ্গে গলা মেলাতাম আমরা তিন বোন, দুই চাচাতো বোন। আমাদের সঙ্গে বাকিরাও কণ্ঠ মেলাতেন। এই একই গান আমরা অনেকবার গাইতাম। দাদার বন্ধুরা সোহরাব হোসেন, আবদুল লতিফ, বেদার উদ্দিনের মতো অনেকে চাঁদরাতে দাদির সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। কেউ হয়তো বলতেন, আমরা তো গ্রামে যাব, তাই আগেই দেখা করতে চলে এলাম।
এই সময় বাড়িতে গানের জলসা বসত। আগের দিনই সেমাই, হালুয়া, চালের আটার রুটি রান্না করা হয়ে যেত, সবার সঙ্গে সেসবও চেখে দেখতাম। আমার দাদি ও চাচি খুবই ভালো রান্না করতেন। আম্মা খুব বেশি রান্না করতেন না, তবে দারুণ মিশুক ছিলেন।
আব্বা জজ হওয়ার আগপর্যন্ত, ১৯৮০ অবধি, আমরা এই এক বাড়িতে ঈদ করেছি। তখন বেশ বড় হয়ে গেছি, সকালে উঠে আব্বা নামাজ পড়ে আসার সময় হাতে করে সমুচাজাতীয় কোনো খাবার কিনে আনতেন। সবাই মিলে সেটা খেতাম। তখন বাবার কাছে হয়তো তাঁর সহকর্মীরা আসছেন, চাচার কাছে সংগীতজগতের লোকজন, দাদির কাছে আত্মীয়স্বজন। দাদির হয়তো মনটা খারাপ, ওনার অনেক বন্ধুবান্ধব মারা গেছেন, আমরা তাঁকে ঘিরে রাখতাম, গল্প করতাম।
ঈদে আমরা জামাকাপড় পেতাম খুবই কম। কোনো ঈদে চাচা বা ফুফু জামা দিলে মা–বাবা আর দিতেন না। বলতেন, তোমার তো জামা হয়েছেই। তোমার বাজেটের অংশটা দিয়ে এবার বরং আমরা রংপুরে গ্রামের কোনো আত্মীয়কে সাহায্য করছি। ঈদের আগে বাবা খুব নিয়ম করে হিসাব করতে বসতেন। এরপর সেখান থেকে জাকাতের টাকাটা আলাদা করে রাখতেন। আজকে এসে ভাবি, এই যে সমাজে একধরনের মানুষের কাছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, আরেক ধরনের মানুষ খেতেই পাচ্ছেন না।
ফুফুর বিয়ের পর তাঁকে দেখার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। ফুফু তখন ব্যস্ত গায়িকা। ঈদের দিন দুপুরে আসতেন, আমরা একসঙ্গে খেতাম। তখন ফুফুকে দেখার জন্য নানিবাড়িতেও যেতে চাইতাম না।
আমার নানিও দারুণ রান্না করতেন। ঈদের সময় অনেক পদের মুখরোচক খাবার তৈরি করতেন। আমরা নানির পটল ছেলা, পোলাও রান্না দেখতাম। নানিও চাইতেন, আমরা তাঁর কাছ থেকে এসব রান্না শিখে রাখি। তখনই হয়তো এসব আমাদের কাজে লাগছে না, কিন্তু এসব দক্ষতা যে পরবর্তী জীবনে আমাকে আরও এগিয়ে নেবে, সেটা তাঁরা ভাবতেন। এই যে আজকে যখন স্কুলের একটা বাচ্চার মুখে শুনি, ‘আমি কেন সহপাঠীদের সঙ্গে স্কুলঘর ঝাড়ু দেব। আমার বাবা তো অমুক বা আমার মা তো তমুক’, তখন খুব খারাপ লাগে। আমরা ছোটবেলায় এসব কখনো ভাবনাতেও আনতে পারিনি। বরং গৌরব হতো, আমি সব কাজ পারি। স্কুলে পড়ার সময়ে দেখেছি, আমাদের বাসায় যিনি গৃহকর্মী ছিলেন, রান্নার পাশাপাশি তিনি শুধু আম্মার পোশাক ধুয়ে দিতেন। আমরা নিজেদের পোশাক নিজেরাই ধুয়ে নিতাম, মা–বাবাই সেটা শিখিয়েছেন।
ঈদে আমরা এক–দুজন আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে যে সালামি পেতাম, সেটাও অন্যদের দিয়ে দিতে আব্বা–আম্মা উৎসাহ দিতেন। আমরাও সেটা অন্যকে দিয়ে তৃপ্তি পেতাম। ছোটবেলার এই শিক্ষা আমিও আমার দুই মেয়ের মধ্যে দিতে চেষ্টা করেছি। আমার দুই মেয়েকে বড় করার দায়িত্বে যে ছিল, সেই মেয়েটি মারা গেছে। আমার দুই মেয়ে তার সন্তানকে নিজেদের টাকায় একটা ঘর বানিয়ে দিয়েছে। ঈদের সময়ও দেখি তাদের মধ্যে নিজের চেয়ে অন্যদের নিয়ে বেশি ভাবনা। কাকে কী দেবে, কার কী লাগবে, নিজেরা সামর্থ্যমতো সাহায্যের চেষ্টা করে। দেখে তৃপ্ত হই, গর্বে বুক ভরে ওঠে।