ছুটি না পাওয়ায় বন্ধুর বিয়েতে যেতে পারেননি নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা। পরদিন সরলীকরণের মাধ্যমে তিনি ফুল ও কেক কিনে পাঠালেন। আরেকজন রাত ১১টার সময় শাহবাগের ফুল ফার্মগেট থেকে নিলেন। শুধু কি তা–ই! হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট ডেলিভারি নেওয়া, বই কিনে পাঠানো, কাগজ সত্যায়িত করে জমা দেওয়াসহ নানা রকম ব্যক্তিগত কাজ করে দেয় সরলীকরণ। এই সেবা পরিচালনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের একদল শিক্ষার্থী। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ জনের বেশি শিক্ষার্থীর দল।
২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে ঢাকায় আসেন আরাফাত হোসেন। কোচিং শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় প্রায়ই তাঁকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের বিভিন্ন কাজ করতে হতো। একদিন আরাফাতের মাথায় এল, পরিচিত হওয়ায় তিনি না–হয় কাজগুলো করে দিচ্ছেন। কিন্তু সবার তো পরিচিতজন না-ও থাকতে পারে। আবার চাইলেই সাহায্য সব সময় পাওয়া যায় না। যদি কোনো স্বীকৃত, আস্থাভাজন জায়গা থাকে—তাহলে সবার জন্যই সুবিধা হবে। ঢাকার যানজট, যাতায়াত খরচ, রাস্তাঘাটের ভোগান্তি—এসব বিবেচনায় সম্মানী দিতেও লোকের আপত্তি করার কথা নয়। এসব ভাবনা থেকেই একটা ব্যবসার ‘আইডিয়া’ মাথায় খেলে যায়।
পরিকল্পনার কথা অগ্রজ ও সহপাঠীদের জানান আরাফাত। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ১১-১২ জন সহপাঠী-বন্ধু এগিয়ে আসেন। তৈরি হয় সরলীকরণের প্রাথমিক দল। এই দলের অন্য সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের আবু বকর সিদ্দিক, অং ক্য চিং মারমা, মেজবা হোসেন, মেহেদী হাসান ও রমজান আলী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের খালিদ হাসান ও ইমাম হোসেন, উর্দু বিভাগের লিটন ইসলাম, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের জামিল হোসেন, আরবি বিভাগের তাহমিদুর রহমান, ইমরান হোসেন এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের আফসার হোসেন।
গ্রাহকদের ব্যক্তিগত কাজ সহজে, সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন করে দেয় সরলীকরণ। তাঁদের কাজের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সনদ, নম্বরপত্র, প্রশংসাপত্র ইত্যাদি মূল্যবান কাগজপত্রের ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করা। অর্থাৎ সরলীকরণের প্রতিনিধিরা আবেদনপত্র জমা দেওয়া, ফি জমা দেওয়া, কাগজ হস্তান্তর, ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেন। ক্যাম্পাসে বিভাগ ও প্রশাসনিক ভবনে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রয়োজন থাকে, সেখানেও তাঁরা সেবা দেন। ওষুধ, পড়ালেখার উপকরণ বা অন্যান্য পণ্য নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন। আরাফাত জানালেন, ঢাকায় বসে রংপুরের কোনো নির্দিষ্ট অফিসে কোনো কাগজ জমা দেওয়ার প্রয়োজন হলেও সরলীকরণ সেই ব্যবস্থা করবে।
ইতিমধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও নোয়াখালী শহরে বিস্তৃতি লাভ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে—দুই জায়গাতেই তাদের সেবা পাওয়া যায়। কাজের সময়, দূরত্ব, পরিশ্রম ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে খরচ। সরলীকরণের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক আরাফাত হোসেন জানান, ক্যাম্পাসে সর্বনিম্ন সার্ভিস চার্জ ৭০-৮০ টাকা (যেমন এক হল থেকে অন্য হলে কাগজপত্র বা পার্সেল পাঠানো)। ক্যাম্পাসের বাইরে কাছাকাছি দূরত্বের মধ্যে এবং কাজটা অল্প সময়ের হলে, দুই বা তিন শ টাকা। এগুলো ছোট ছোট কাজের হিসাব। কিছু কিছু কাজ করতে কয়েক দিন বা সপ্তাহখানেক লাগে, সে ক্ষেত্রে খরচ হাজার টাকাও অতিক্রম করে।
২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করেছিল সরলীকরণ। দেড় বছর পুরো হওয়ার আগেই সারা দেশে তারা প্রায় পাঁচ শ কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যেখান থেকে তাদের আয় হয়েছে দুই লাখ টাকার বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন বলেন, ‘সার্ভিস চার্জের ৭০-৮০ ভাগ টাকাই প্রতিনিধিকে দেওয়া হয়। কোনো কাজে বিল খুব কম হলে পুরোটা দেওয়ারও নিয়ম আছে। সাধারণত, ছোট কাজগুলোতেই এমনটা হয়।’
সরলীকরণকে আরও বেশি মানুষের নিকট পৌঁছে দিতে চান আরাফাত। তিনি চান, প্রয়োজনের সময় দূরত্ব বা অবস্থানগত বাধা যেন না থাকে। অপরিচিত একজন মানুষকেও আরেকজন চোখ বন্ধ করেই যেন বিশ্বাস করতে পারে। আরও বহু শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়াও সরলীকরণের লক্ষ্য।