২০২২ সালের ১৬ জুন। সুনামগঞ্জে তখন ভয়াবহ বন্যা। সন্ধ্যায় শহর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন সাগর সরকার। পথে বন্যার পানির প্রবল তোড় তাঁকে হাওরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অন্ধকার রাতে তুমুল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সাঁতার কাটতে থাকেন। কিন্তু কিছুতেই আর কূল খুঁজে পান না। তারপর? তাঁর মুখ থেকে সেই রুদ্ধশ্বাস গল্পই শুনেছেন খলিল রহমান
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা সদরের তিররাই গ্রামে আমাদের বাড়ি। ছাতক বাজার থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটারের মতো। বাজারে আমার একটা ওষুধের দোকান আছে। ১৬ জুন দুপুরে পাশের গ্রামের এক পরিচিত ব্যক্তি ফোন করেন। তাঁর ঘরের এক শিশু অসুস্থ, জরুরি কিছু ওষুধ লাগবে। এ জন্য দোকানে যেতেই হবে। যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু কোনো উপায়ও ছিল না। বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, মানুষের বেশির ভাগ বাড়িঘর তখন প্লাবিত। অনেকটা যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জ। চারদিকে থইথই পানি। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। পানি বাড়ছে।
মন সায় না দিলেও অসুস্থ শিশুর কথা ভেবে একসময় ঘর থেকে বের হই। এরপর ওই ব্যক্তির নৌকায় করে বাজারে যাই। কথা ছিল, তাঁর নৌকা করেই আবার আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। কিন্তু তখন আরও কয়েকজনকে বাড়ি পৌঁছে দিতে নৌকা নিয়ে তাঁর গ্রামে যান তিনি। বাড়ি গিয়ে দেখেন বাচ্চার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে ঘরের আসবাব, গোলায় রাখা ধান। তাই তিনি আর আসতে পারেন না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি ফেরার জন্য দোকান থেকে বের হই। শ্যামপাড়া-কান্দিগাঁও সড়ক ধরে হাঁটতে থাকি। পথে কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমরপানি। মুঠোফোনসহ অন্য জিনিসপত্র একটা পলিথিনে ভরে নিয়েছি। ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ যে যেভাবে পারছে বাড়ি ফিরছে। পথে মাদুকোনী গ্রামের দক্ষিণ মাথায় গিয়ে দেখি প্রবল স্রোতে রাস্তা ভেঙে গেছে।
বাড়িতে ফোন দিয়ে একটি নৌকা নিয়ে আসতে বলি। কিন্তু বাড়ির লোকজন সম্ভবত নৌকা জোগাড় করতে পারছিল না। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে আমার মুঠোফোনটা ভিজে গেছে। আর কল করতে পারি না। একপর্যায়ে ওই ভাঙা রাস্তাটুকু পার হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পানিতে নেমে সামান্য এগোনোর পর স্রোতের তোড়ে ভেসে যাই।
প্রচণ্ড স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। কোথায় যে যাচ্ছি, বুঝতে পারি না। বৃষ্টির মধ্যেই সাঁতার কাটতে থাকি। কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। কখনো ভেসে, কখনো ডুবেই সাঁতার কাটতে থাকি। একসময় মনে হয়, বিলের মাঝখানে চলে এসেছি। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তবু হাল ছাড়ি না। এভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা সাঁতার কেটেও আশপাশে কোনো গ্রাম দেখি না। কোন দিকে যাব, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আবার সাঁতার কাটতে শুরু করি। একপর্যায়ে বিলের মধ্যে একটি গাছ পেয়ে যাই। একটাই গাছ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। ডাল ছুঁই ছুঁই পানি।
গাছের ডাল ধরে ভেসে চিৎকার করতে থাকি। কিন্তু কাউকেই কোথাও দেখি না। এই পরিস্থিতিতে এখানে কেউ আসার কথাও না। সময় যায়, ঠান্ডায় শরীর জমে আসে, ভয় বাড়ে। অন্ধকারের মধ্যে একবার যেন মনে হয় বাবার চিৎকার শুনি। তিনি আমাকে ডাকছেন। মনে হচ্ছে তাঁরা নৌকা নিয়ে এসে আমাকে খুঁজছেন। আমিও চিৎকার করি। কিন্তু বৃষ্টিঝড়ের মধ্যে তাঁরা আমার চিৎকার শুনতে পান না। আমাকে না পেয়ে তাঁরা চলে যান। আমার মনটা ভেঙে যায়। কান্না চলে আসে। অসহায় হয়ে কোনোরকমে গাছে উঠে বসি। শরীর কাঁপছে। নিজেকে শক্ত রাখি। মনে মনে বলি, আমাকে বাঁচতে হবে। শান্ত থাকার চেষ্টা করি। সারা রাত ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ওই গাছেই কাটে।
রাত শেষে সকাল হয়। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। অনেক দূরে গ্রাম। হাওরে ঢেউ, স্রোত। কোথাও কেউ নেই। ভাবি, শরীরে বল থাকতে থাকতে আবার সাঁতার কাটতে হবে। আবার ভয়ও হয়, পানিতে নেমে মাঝপথে যদি ডুবে যাই। এসব ভেবে অপেক্ষা করতে থাকি। মনে হয় কেউ হয়তো এদিকে আসবে। আমার খোঁজে বাড়ি থেকেও কেউ আবার আসতে পারেন।
একসময় দেখি একটি নৌকা আসছে। মনে আশা জাগে। নৌকায় একটি পরিবার। জোরে পরিবারের লোকজনকে ডাকি। নৌকা থেকে একজন আমাকে দেখে ফেলেন। তাঁরা এগিয়ে আসেন। আমাকে নৌকায় তুলে নেন। আনন্দে আমার কান্না চলে আসে।
তাঁরা আমাকে বিলের পাড়ের মুক্তিরগাঁওয়ের একটি সেতুর ওপর তুলে দেন। আমার শরীর তখন বড় ক্লান্ত, হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছিল। কোনোরকমে হেঁটে গ্রামের রহিম আলী চাচার বাড়িতে গিয়ে উঠি। তিনি আমার বাবার পরিচিত। আমাকে দেখে ঘরের সবাই অবাক। চাচা জড়িয়ে ধরেন। দ্রুত ভেজা কাপড় বদলানোর ব্যবস্থা করেন। এরপর খেতে দেন।
খেতে খেতে রহিম চাচার কাছে শুনি, এলাকার সবাই মনে করছে আমি মারা গেছি।